E-Paper

পুর গর্জনই সার, ১২৭টি অবৈধ বাড়ির মধ্যে ভাঙা হয়েছে ২৭টি!

বেআইনি নির্মাণে ছেয়ে গিয়েছে এলাকা। পুরসভা তবু ‘নিষ্ক্রিয়’। ঘুরে দেখল আনন্দবাজার।

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:১১
বিপজ্জনক: গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর রোডে একটি বহুতলের গায়ে হেলে পড়েছে পাশের বহুতল।

বিপজ্জনক: গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর রোডে একটি বহুতলের গায়ে হেলে পড়েছে পাশের বহুতল। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

গত বছরের ১৭ মার্চ গভীর রাতে গার্ডেনরিচের আজহার মোল্লা লেনে নির্মীয়মাণ বেআইনি বহুতল ভেঙে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩ জন। সংশ্লিষ্ট বহুতলটির প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম এখন জেলবন্দি। ওই বিপর্যয়ের পরে পুরসভা জানতে পেরেছিল, ভেঙে পড়া বহুতলটির কাছে আরও একাধিক বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ওয়াসিম। যেগুলির মধ্যে রয়েছে হরিবাবু পল্লি লেনের একটি বহুতল। মার্চ মাসেই সেই নির্মাণটি ভেঙে ফেলার জন্য নোটিস দিয়েছিল পুরসভা। কিন্তু ওই ঘটনার ১০ মাস পরে শুক্রবার গার্ডেনরিচ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, কোথায় কী! হরিবাবু পল্লি লেনের বহুতলটি বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘‘এই বাড়িটি ধীরে ধীরে পাশের বাড়ির গায়ে হেলে পড়ছে। পুরসভা কবে বাড়িটি ভাঙবে, বা আদৌ ভাঙবে কিনা, তা তারাই জানে।’’

এই প্রশ্নের উত্তর সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন স্থানীয় ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীল। তাঁর দাবি, ‘‘গার্ডেনরিচে বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে এসে পুরকর্মীরা নিত্যদিন মার খাচ্ছেন। প্রোমোটার ও তাঁর লোকজনেরা চড়াও হচ্ছেন পুরকর্মীদের উপরে। তাঁদের নিরাপত্তা দেবে কে?’’ যদিও বরো চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণ ভাঙার দায়িত্ব পুরসভার আধিকারিকদের। সেই দায়িত্ব বরো চেয়ারম্যানের নয়। উনি এলাকায় যান না। অকারণে বেশি কথা বলেন।’’ তবে, দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকেরা সংশ্লিষ্ট নির্মাণটি ভাঙতে না পারায় বিল্ডিং দফতরের দায়িত্বে থাকা ফিরহাদ তাঁদের সতর্ক করেছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি।

১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন আজহার মোল্লা লেনে এ দিন গিয়ে দেখা গেল, গত বছরের ১৭ মার্চ যে নির্মীয়মাণ বেআইনি বহুতলটি ভেঙে পড়েছিল, সেটির ধ্বংসাবশেষ এখনও পুরো পরিষ্কার করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, কাছাকাছি থাকা একাধিক বহুতলের মধ্যে দৃশ্যত কোনও ফাঁক নেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ‘‘বিল্ডিং দফতরের কোনও নিয়ম এখানে মানা হয় না। রাস্তার পরিসরের অনুপাতে যে আয়তনের বা যত তলবিশিষ্ট বাড়ি হওয়ার কথা, তা তৈরি হয় না।’’ তাঁরা আরও বলছেন, নিয়ম মেনে বাড়ি তৈরি করার বিষয়টি কার্যত উঠে গিয়েছে। যে কোনও বাড়ি হচ্ছে অন্তত পাঁচতলা। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ‘‘তেতলা বাড়ির ভার কি পাঁচতলা সইতে পারে? ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। হয় সেই বাড়ি ভেঙে পড়ছে, না হয় হেলে যাচ্ছে। আজহার মোল্লা লেনের ওই বাড়িটির দোতলা পর্যন্ত অনুমোদন ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছিল পাঁচতলা।’’

শুধু আজহার মোল্লা লেনই নয়। গার্ডেনরিচের পাহাড়পুর রোডে গিয়েও এ দিন দেখা গেল, একাধিক বহুতল পরস্পরের গায়ে প্রায় ঘেঁষে রয়েছে। এমনই দু’টি বহুতলের একটি অন্যটির উপরে হেলে পড়ায় পুরসভা দু’টি বহুতলই ফাঁকা করতে নোটিস দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাড়ি দু’টি ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু এখনও সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি। এই প্রসঙ্গে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘এখানে সব টাকার বিনিময়ে ঠিক হয়ে যায়। কেউ বেআইনি বাড়ি ভাঙতে পারবে না।’’

এর দায় বরো চেয়ারম্যান রঞ্জিত চাপিয়েছেন বাড়িওয়ালাদের উপরে। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িওয়ালারা আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় বেআইনি নির্মাণ ভাঙা যাচ্ছে না। তবে পুরসভা হাত গুটিয়ে বসে নেই। বেশ কিছু অবৈধ নির্মাণ ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে।’’

গত ২৮ জুন থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পাওয়া পুরসভার পরিসংখ্যানই বলছে, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকায় ১২৭টি বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। যার মধ্যে ভাঙা হয়েছে মাত্র ২৭টি। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘‘বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গেলে পুরপ্রতিনিধিরাই বাধা দিচ্ছেন। এমন চলতে থাকলে কোনও দিন কি লাগাম টানা সম্ভব বেআইনি নির্মাণে?’’ তাঁদের সাফ কথা, ‘‘মেয়র যতই দাবি করুন নতুন করে বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে না, বাস্তব কিন্তু একেবারে উল্টো। আজহার মোল্লা লেনে বহুতল ভেঙে পড়ার পরে পুরসভার তরফে খাতায়কলমে অনেক নিয়ম হয়েছে। আসল চিত্রটা একটুও বদলায়নি।’’

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Constructions Dangerous Building

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy