প্রায় কয়েক কোটি টাকার বাজি। পরিমাণে অন্তত ১০ হাজার কিলোগ্রাম। কালীপুজোর দিন দশেক আগে থেকে ছটপুজো পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ এই পাহাড়প্রমাণ নিষিদ্ধ বাজি উদ্ধার করেছে বলে জানাচ্ছে পুলিশেরই রিপোর্ট। আর এই বাজিই এখন ঘুম কেড়েছে উর্দিধারীদের। প্রথমে ‘সেফ হাউজ়’ ঠিক করে সেখানে এই বাজি রাখার পরিকল্পনা করা হলেও এত বাজি এক জায়গায় রাখা বিপজ্জনক। তার উপরে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) অনুযায়ী, বাজি রাখার সামগ্রিক প্রক্রিয়া ভিডিয়োগ্রাফি করে রাখার কথা। ফলে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই থানায় থানায় রাখা হয়েছে বাজেয়াপ্ত করা ওই বাজি। সেগুলির নজরদারিতে ডিউটি দিতে হচ্ছে পুলিশকর্মীদের। সেই সঙ্গে এত বাজি এখনও নিষ্ক্রিয় করতে না পারা নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ছটপুজো কেটে যাওয়ার পরে সপ্তাহ ঘুরতে চলল, তবু বাজি নিষ্ক্রিয় করা গেল না কেন? বাহিনীর অন্দরের খবর, বাজি সংক্রান্ত বহু মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেগুলি নিষ্ক্রিয় করা যাচ্ছে না। ফলে থানায় থানায় শুধু বাজির জন্যই আলাদা ভাবে পাহারা বসাতে হচ্ছে। পূর্ব কলকাতার এমনই একটি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বললেন, ‘‘হয় সিভিক ভলান্টিয়ার, নয়তো কনস্টেবল পদের কাউকে পাহারায় রাখতে হচ্ছে। কোনও ভাবে আগুন ধরে গেলে তো রক্ষে নেই। যাঁদের ধূমপান করার অভ্যাস আছে, তাঁদের বলা হয়েছে বাজির জায়গা থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার জন্য।’’
সাম্প্রতিক অতীতে বাজি বিস্ফোরণে মহেশতলা, বজবজ, নোদাখালির ‘বাজি মহল্লা’র পাশাপাশি মেদিনীপুর, উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের মতো একাধিক জায়গায় একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। মজুত বাজির বিপদ দেখা গিয়েছে নৈহাটি, চুঁচুড়ায়। ছাদ ধসে, বাড়ির চাল উড়ে গিয়ে এবং জানলার কাচ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার প্রায় ৫০০টি বাড়ি। জানা গিয়েছিল, উদ্ধার হওয়া বাজি এবং বাজি তৈরির মশলা এক জায়গায় রেখে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছিল পুলিশ। অসাবধানতায় তাতেই ঘটে বিপত্তি। তবে শুধু সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতেই নয়, একাধিক থানাতেও উদ্ধার হওয়া বাজিতে আগুন ধরার ঘটনা ঘটেছে এর আগে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের জিম্মায় থাকা বাজি নিয়েই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা অবিক্রীত বাজির কী হবে? সে সব কি জনবসতি এলাকাতেই ঝুঁকি নিয়ে রেখে দেওয়া হবে?
এমনিতে সরকারি জিম্মায় থাকা বাজি হলদিয়ায় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড’-এর ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে জমিতে প্লাস্টিকের ফাঁকা জলাধারের মধ্যে লোহার পাটাতন পাতা হয়। পাটাতনের উপরে ইট, সুরকি, বালির মিশ্রণ ঢেলে তার উপরে রাখা হয় বাজি। এর উপরে আর এক দফায় ওই মিশ্রণ ঢেলে জলাধারের মুখ আটকে বসিয়ে দেওয়া হয় মাটির গভীরে। কয়েক বছর পরে এই বাজিই বোল্ডারের আকার ধারণ করে।
তবে বাজি ব্যবসায়ীদের সংগঠনের কর্তারা জানাচ্ছেন, ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা অবিক্রীত বাজি রাখার জন্য ‘ম্যাগাজ়িন’ অর্থাৎ, ছোট ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। ফাঁকা জমিতে কয়েকশো মিটার অন্তর এমন ঘর বানানো থাকে। সেখানেই তাপ নিরোধক পদ্ধতিতে বাজি রাখা থাকে। ওইঘরে বাল্ব জ্বালানো নিষিদ্ধ, যখন-তখন প্রবেশও করা যায় না। বছরে এমন ঘরে বাজি রাখতে কার্টন পিছু ভাড়া গুনতে হয় প্রায় ৭০০-৮০০ টাকা। কিন্তু যেখানে বেআইনি বাজির কারবার বন্ধ করা যায় না, সেখানে কি ব্যবসায়ীরা অর্থ ব্যয় করে ম্যাগাজ়িন-এ অবিক্রীত বাজি রাখবেন? উত্তর মেলে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)