Advertisement
১১ মে ২০২৪
রাজনীতি, সিন্ডিকেট আর প্রোমোটারির ত্রিফলায় হাওড়া এখন অপরাধ-নগরী। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্কৃতীরা। যখন-তখন
Murder

এলাকা দখলের মরিয়া চেষ্টাতেই পর পর খুন

গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশ্য রাস্তায় খুনের সেই ভয়াবহ দৃশ্য এখনও ভোলেননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। সে দিন এ ভাবেই খুন হয়েছিল মহম্মদ আবদুল্লা ওরফে পোলাড।

হাওড়ার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে নির্মীয়মাণ ‘অবৈধ’ বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

হাওড়ার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে নির্মীয়মাণ ‘অবৈধ’ বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:৩৮
Share: Save:

কার্তিক মাসের এক রাত। বাতাসে হাল্কা শীতের আমেজ। রাত ৯টার সময়েও গমগম করছে হাওড়ার শিবপুরের রামকৃষ্ণপুর তালতলা মোড়। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে এক মোটরবাইক আরোহীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল জনা ছয়েক যুবক। তার পরে তাঁকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে, গুলি করে ফের হাঁটতে হাঁটতেই চলে গেল তারা।

গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশ্য রাস্তায় খুনের সেই ভয়াবহ দৃশ্য এখনও ভোলেননি প্রত্যক্ষদর্শীরা। সে দিন এ ভাবেই খুন হয়েছিল মহম্মদ আবদুল্লা ওরফে পোলাড। শিবপুরের জিটি রোড লাগোয়া পিএম বস্তির বাসিন্দা এক দাগি দুষ্কৃতী। গত জানুয়ারিতে পিএম বস্তির কাছেই একটি ট্রলি ভ্যানের উপরে মিলেছিল পোলাড-বিরোধী মানোয়ার আলি ওরফে জিজুয়ার গলা কাটা দেহ। পুলিশের দাবি, জিজুয়াকে খুনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত ছিল পোলাড। ওই খুনের ষড়যন্ত্রের মূল মাথা আব্দুল কাদির ওরফে প্রেমকে মুম্বই থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। পোলাড ধরা পড়েছিল হাওড়া থেকেই।

এরই মধ্যে গত বছরের শেষ দিকে খুন হয় লোহা নামে আর এক দুষ্কৃতী। লোহাকে খুনের অভিযোগে প্রেম-বিরোধী গোষ্ঠীর মহম্মদ তৌসিফ ওরফে গ্যাঁড়া, মহম্মদ সাদ্দাম, মহম্মদ কাল্লু-সহ আরও তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কয়েক মাস আগে জামিনে ছাড়া পেয়ে দুই গোষ্ঠীর লোকজনই এলাকায় ফিরে আসে।

‘খুনের বদলে খুন’— পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে এই ‘স্লোগান’ তুলেই পথে নেমেছে দুষ্কৃতীরা। যার ফলে ফের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে হাওড়ার অপরাধ জগতে। সক্রিয় হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক নেতাদের ছাতার নীচে থাকা ‘বড়দা’, ‘সিংদা’ বা ‘খানদা’র মতো প্রোমোটার চক্রের মাথারা। শিবপুরের পিএম বস্তি থেকে মৌরিগ্রামের ইন্ডিয়ান অয়েল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চলা সিন্ডিকেট-চক্র এখন আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছে। এলাকা ভাগ করে নিয়ে চলছে সিন্ডিকেট-চক্রের অবাধ কারবার। বালি, সিমেন্ট, পাথর সরবরাহের বেনজির জুলুমবাজি।

হাওড়া শহরে শিবপুর থেকে নাজিরগঞ্জ পর্যন্ত গঙ্গার ধার বরাবর বিভিন্ন এলাকায় এবং জিটি রোড সংলগ্ন বিভিন্ন ওয়ার্ডে একের পর এক বহুতল আবাসন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে গত কয়েক বছরে। অভিযোগ, আবাসন-পিছু ২০০-৩০০ টাকা প্রতি বর্গফুট দরে দাদাদের হাতে ‘নজরানা’ তুলে দিলেই অবাধে উঠে যাচ্ছে বেআইনি বহুতল। তাই প্রোমোটারেরাও চুপ। একটিও অভিযোগ জমা পড়ে না পুলিশের কাছে। হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, এই প্রোমোটারি-রাজ মূলত চলছে ২৮, ৩১, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭ এবং ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।

পুলিশের একাংশের মতে, এলাকা দখল নিয়ে দাদাদের পোষা দুষ্কৃতী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এই কারণেই। অপরাধের ‘হটস্পট’ শিবপুরে খুনের বদলা খুনের পিছনেও রয়েছে এই দাদাদের অদৃশ্য হাত।

কেমন সেই হাত?

পিএম বস্তির এক বাসিন্দা জানান, দুষ্কৃতীদের দু’টি গোষ্ঠীর জন্য শিবপুর এলাকা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হল পিএম বস্তি, যা দুষ্কৃতীদের ভাষায় ‘বাগান’ বলে পরিচিত। অন্য অংশটি হল শিবপুর ট্রাম ডিপো, জিসিআরসি ঘাট এলাকা-সহ বাকি তিনটি বস্তি। সেটাই দুষ্কৃতীদের কাছে ‘শিবপুর’। এই দুই এলাকার দখল নিয়েই শুরু হয়েছে লড়াই। কারণ, এখানেই উঠছে একের পর এক বহুতল। পুলিশের মতে, যত দিন পিএম বস্তি, মাদ্রাজি পাড়া-সহ হাওড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’ ছিল কুখ্যাত দুষ্কৃতী রামুয়া, তত দিন বাগান বা শিবপুর দখল করার কথা কেউ ভাবতে পারত না। বছরখানেক আগে রামুয়া খুন হয়ে যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে এলাকা দখলের লড়াই। রাজনৈতিক নেতার ছদ্মবেশে এলাকার ‘বড়দা’ পড়শি রাজ্য থেকে দুষ্কৃতীদের আনিয়ে নেমে পড়েছেন সেই লড়াইয়ে।

পিএম বস্তির এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘বড়দার মদতে জেল থেকে ফিরে আসা প্রেমের দলবল পিএম বস্তিতে মাথাচাড়া দিতেই ১৬ নভেম্বর রাতে পোলাডকে কুপিয়ে, গুলি করে খুন‌ করেছে প্রেমের বিরোধী গোষ্ঠীর মাথা মহম্মদ তৌসিফ ওরফে গ্যাঁড়ার দলবল। ফের পাল্টা খুনের অপেক্ষায় আছি আমরা। জানি না, এ বার কার পালা।’’ (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Shibpur Territory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE