রোগীদের কল্যাণে বরাদ্দ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে সাফাইকর্মীদের বেতনে! এক-আধ বার বিচ্ছিন্ন ভাবে নয়। টানা পাঁচ বছর ধরে। প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা করে!
অবশেষে এই ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এসে টনক নড়েছে রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। রোগীকল্যাণ সমিতির (আরকেএস) নির্দেশিকা ঘেঁটে তাঁরা দেখেছেন, ‘আরকেএস স্টাফ’ হিসেবে অস্থায়ী বা স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে প্রতি মাসে আরকেএস তহবিল থেকে তাঁদের বাঁধা মাইনে দেওয়ার কথা নির্দেশিকায় বলা নেই। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান, আরকেএসের টাকায় কোনও কর্মীকে দিয়ে এক বার কোনও কাজ করিয়ে এককালীন টাকা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাঁধা বেতনে কর্মী নিয়োগ করে প্রতি মাসে বেতন দেওয়া যায় না। অথচ, এসএসকেএমে সেই ‘অনিয়ম’ই হয়ে চলেছে।
২০১১ সালের অগস্ট মাস থেকে এই হাসপাতালের আরকেএসে মোট ১০৮ জন অস্থায়ী সাফাইকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে আরকেএস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তিন লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই খোঁজখবর শুরু করেছেন এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কে বা কারা, কেন এটা শুরু করেছিল, জানি না। এখন বিষয়টি নজরে এসেছে। আমি অ্যাকাউন্টস অফিসারের সঙ্গে বসে সব খতিয়ে দেখছি।’’ স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, কলকাতার আর কোনও মেডিক্যাল কলেজেই এ রকম নজির নেই।
এসএসকেএম সূত্রের খবর, তৃণমূল সরকার প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পরে মূলত চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের একাংশের চাপে তৎকালীন কর্তারা এটা চালু করেন। তখন আরকেএসে টাকার জোগান ছিল প্রচুর। ফলে এই অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। এখন সরকারি হাসপাতালের সব পরিষেবা ‘ফ্রি’ হওয়ায় আরকেএসে সঞ্চয়ের পরিমাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। কারণ পেয়িং বেডের রোগীদের থেকে কোনও রোজগার হচ্ছে না। ফলে এখন অনেক সময়েই প্রয়োজনে রোগীর ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রী কেনা যাচ্ছে না। ফলে এখন অনিয়ম নিয়ে নড়েচড়ে বসেছেন সকলেই।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, এসএসকেএমের আরকেএসে এখন মেরেকেটে ৪০ লক্ষ টাকা জমা রয়েছে। একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ক্ষেত্রে যা যথেষ্ট কম। কারণ, এখন প্রয়োজনে এক জন রোগীর জন্য ক্যানসারের একটা ওষুধ বা ওপেন হার্ট সার্জারির কোনও চিকিৎসামগ্রী কিনতেই এক-দেড় লক্ষ টাকা বেরিয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ— কাউকে যেন কোনও ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে না হয়। এই পরিস্থিতিতে প্রতি মাসে আরকেএস তহবিল থেকে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা শুধু বেতন দেওয়ার চাপ এসএসকেএম নিতে পারছে না।
কিন্তু এর পরেও ওই কর্মীদের সরানো যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কারণ, রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘অতগুলো লোককে তো এক কথায় সরিয়ে দেওয়া যায় না। আগে ওঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তা হলে কি জেনেশুনে অনৈতিক ভাবে রোগীদের কল্যাণের টাকায় তাঁদের বেতন দেওয়া দেওয়া হবে? অরূপবাবু বলেন, ‘‘এ সব বিতর্কিত বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’
এসএসকেএমের নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, মোট চার ধরনের সাফাইকর্মী রয়েছেন ওই হাসপাতালে— ১) প্রাক্তন সেনাকর্মীদের থেকে নেওয়া সাফাইকর্মী। ২) সরকারি সাফাইকর্মী। ৩। বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া সাফাইকর্মী এবং ৪। আরকেএস থেকে নেওয়া সাফাইকর্মী। এসএসকেএমে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষের পদে থাকা প্রদীপ মিত্রের কথায়, ‘‘আরকেএসের গাইডলাইনে এর তহবিলের টাকায় কর্মীদের বেতনের কথা ছিল না। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা পুরোপুরি ‘ফ্রি’ হওয়ার আগে আরকেএসগুলিতে বিপুল টাকা জমা পড়ত। আমার সময়েই পিজি-র আরকেএসে মাসে ৬০-৭০ লক্ষ টাকা জমা পড়ত। তখন স্বাস্থ্য ভবন ঠিক করেছিল, প্রাথমিক নির্দেশিকায় না থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই টাকা থেকে বেতন দিলে ক্ষতি নেই। এখন আরকেএসের টাকায় টান পড়াতেই সমস্যা বেধেছে।’’ স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গে কয়েকটি হাসপাতালে আরকেএসের টাকায় টেকনিশিয়ান নিয়োগ হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। তাঁদের ছাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে টানাপড়েনও চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy