Advertisement
E-Paper

শ্বাস নেওয়ার খরচ ৭০ হাজার! কালোবাজারে দমবন্ধ রোগীর

১৫০০ লিটার অক্সিজেন ভরা গোটা সিলিন্ডার কিনলে দাম পড়বে ৭০ হাজার! যত দেরি করবেন, রেট আরও বাড়বে!

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১৯
জীবনদায়ী: এম আর বাঙুর হাসপাতালে এক কোভিড রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার ঠিক করে দিচ্ছেন পিপিই পরা এক স্বাস্থ্যকর্মী।

জীবনদায়ী: এম আর বাঙুর হাসপাতালে এক কোভিড রোগীর অক্সিজেন সিলিন্ডার ঠিক করে দিচ্ছেন পিপিই পরা এক স্বাস্থ্যকর্মী। নিজস্ব চিত্র।

ঘটনা ১: হঠাৎ প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল গিরিশ পার্কের বয়স্ক দম্পতির। একমাত্র মেয়ে রাতভর হাজার ফোন করেও অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে পারেননি। একটি নম্বর থেকে শুধু বলা হয়েছে, “একটাই সিলিন্ডার আছে। ৬০ হাজার টাকা লাগবে!” তৎক্ষণাৎ অত টাকার ব্যবস্থা হবে কী করে! অক্সিজেনের অভাবে শেষে বাড়িতে পড়ে থেকেই মৃত্যু হয় বৃদ্ধের। তাঁর স্ত্রী আপাতত একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ঘটনা ২: কোভিড পজ়িটিভ থাকার চার দিনের মাথায় হঠাৎ অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে যাদবপুরের শ্রীকলোনির বাসিন্দা এক মহিলার। দিনভর চেষ্টা করেও কোনও হাসপাতালে শয্যা মেলেনি। অক্সিজেনের জন্য ফোন করে তাঁর ছেলেকে শুনতে হয়েছে, “পুরনো রেট ভুলে যান। এই এলাকায় এক দিনের সিলিন্ডারের ভাড়া এখন ১৬ হাজার টাকা চলছে। ১৫০০ লিটার অক্সিজেন ভরা গোটা সিলিন্ডার কিনলে দাম পড়বে ৭০ হাজার! যত দেরি করবেন, রেট আরও বাড়বে!” শেষে বাধ্য হয়ে এক দিনের জন্য সিলিন্ডার ভাড়ায় নিয়েছেন ওই মহিলার ছেলে।

গত কয়েক দিনে এমন ঘটনা সামনে আসার বিরাম নেই। অক্সিজেনের হাহাকার এই মুহূর্তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মৃত্যুভয় আরও জাঁকিয়ে বসছে এ শহরের বাসিন্দাদের বড় অংশের মনে। এর সঙ্গেই ভিন্‌ রাজ্য থেকে অক্সিজেনের অভাবে একের পর এক মৃত্যুর খবর সেই ভয়কেই যেন কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে অক্সিজেন নিয়ে শহরে কালোবাজারি শুরু হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ঘিরে। অবস্থা এমনই যে সাধারণ সময়ে ১৫০০ লিটারের বি-টাইপ অক্সিজেন সিলিন্ডার যেখানে আড়াই-তিন হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যেত, মাসে এক বার রিফিলিং করতে খরচ পড়ত ২৫০ টাকা, এখন তার জন্যই দিতে হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। একটি বি-টাইপ সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে রাখতে এমনি সময়ে যেখানে সাত হাজার টাকা খরচ পড়ত, এখন সেখানে এমন একটি সিলিন্ডার কিনতে দাম হাঁকা হচ্ছে ৬০ বা ৭০ হাজার টাকারও বেশি! অভিযোগ, এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে ‘রেমডেসিভিয়ার’-এর মতো ‘অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ’ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের একাংশের কৃত্রিম চাহিদা তৈরির চেষ্টা।

সূত্রের খবর, অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা করতে লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। এই মুহূর্তে এমন বহু জনের কাছে খালি সিলিন্ডার রয়েছে যাঁদের কোনও রকম লাইসেন্সই নেই। দিন কয়েক আগে পাঁচ হাজার টাকায় কিনে রাখা সেই সব সিলিন্ডার তাঁরা ৬০ হাজারে, ৭০ হাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। একই অবস্থা রেমডেসিভিয়ারের ক্ষেত্রেও। এক ভুক্তভোগীর দাবি, “সরকার বলছে, এই ওষুধ হাসপাতাল দেবে। কিন্তু বহু বেসরকারি হাসপাতাল রোগীর পরিবারকেই এই ওষুধ কিনে আনতে বলছে। কিনতে গেলে ওষুধের দোকান ফিরিয়ে দিচ্ছে। কোথাও এক একটি পাতার দাম চাওয়া হচ্ছে ৪০ হাজার টাকারও বেশি!”

কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি? ওষুধের দোকানের মালিক থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অক্সিজেন ব্যবসায়ীদের বড় অংশই এর জন্য পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাকে দায়ী করছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই রাজ্যে অক্সিজেন তৈরি হলেও অক্সিজেনের সিলিন্ডার বানানো হয় না। সিলিন্ডারের জন্য বাংলাকে নির্ভর করতে হয় অন্য রাজ্যের কোম্পানির উপর। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে গত এক মাস ধরে সেই সব কোম্পানি আর নতুন করে সিলিন্ডার পাঠাচ্ছে না।

একটি ওষুধের বিপণি চেনের শ্যামবাজার শাখার ম্যানেজার বিশ্বনাথ ঘোষ বললেন, “কেন অক্সিজেন সিলিন্ডার আসছে না, এ নিয়ে প্রশাসনের হেলদোল নেই। শুধু মাত্র হাসপাতালে জোগান রেখে কিন্তু এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়া যাবে না।” সৌম্যদীপ মণ্ডল নামে আর এক অক্সিজেন ব্যবসায়ী বললেন, “প্রতিদিন দেড় থেকে দু’হাজার লোকের ফোন পাচ্ছি। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমাদের কাছে দেওয়ার মতো অক্সিজেন সিলিন্ডারই নেই। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ব্যবসার নামে মোটা টাকায় সিলিন্ডার বিক্রি করছে, কিন্তু এই আকালে কাউকে সিলিন্ডার বিক্রি করে দিলে শুধু তাঁর পরিবার সাহায্য পায়। কিন্তু সিলিন্ডার ভাড়া দিতে পারলে একটা সিলিন্ডার দিয়েই অন্তত সাত-আটটা পরিবারের কাজ হয়ে যায়।”

এর সঙ্গেই সিলিন্ডারের উপরে লাগানোর ‘এফএ ভালভ’ বা ‘হিউমিডিফায়ার’-এরও প্রবল আকাল চলছে বলে জানান সৌম্যদীপবাবু। তাঁর কথায়, “সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন বেরোনোর মাত্রা ‘এফএ ভালভ’ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এ জন্য ১ থেকে ১৫ পর্যন্ত মাপকাঠি থাকে। ১ মাপকাঠির অর্থ, প্রতি মিনিটে
১ লিটার অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে বেরিয়ে যাবে। ‘হিউমিডিফায়ার’-এর কাজ হল, বেরিয়ে আসা অক্সিজেন রোগীকে নিতে সাহায্য করা। কিন্তু এই যন্ত্রগুলিই না পাওয়া গেলে অক্সিজেন থেকেই বা লাভ কী? প্রশাসনের ব্যাপারটা দেখা উচিত।”

স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার যদিও মন্তব্য, “রেমডেসিভিয়ার নিয়ে জানি না, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অক্সিজেন কেনাই যাবে না বলে তো নির্দেশ জারি হয়েছে। এর পরেও কেউ কোনও দুর্নীতি করলে সেটা পুলিশের দেখার কথা।” লালবাজারের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক আধিকারিক বললেন, “এই জরুরি সময়ে কেউ কারও প্রাণ বাঁচাতে কিছু কিনতে চাইলে সব ক্ষেত্রে আটকানো হবে কী করে? কালোবাজারি রুখতে বাহিনী সতর্ক রয়েছে। তবে অক্সিজেনের মতো কিছু জিনিসের যে সত্যিই ঘাটতি রয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।” কালোবাজারি বন্ধের পাশাপাশি এই ঘাটতিই বা মিটবে কবে? এ প্রশ্নের অবশ্য উত্তর নেই প্রশাসনের কারও কাছেই।

COVID-19 coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy