Advertisement
E-Paper

৮৩-তে ক্রিজ় আঁকড়ে রয়েছি আমি, আউট করোনা

৮৩ বছরের আমি তিন শয্যাশায়ীকে সামলে করোনাকে আউট করে ক্রিজ়ে থাকতে পারলে, আপনারা পারবেন না?

প্রভাত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২১ ০৫:৫৭
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

৮৩-তে আমি নট আউট। করোনা আউট। শুধু আউটই করিনি, আমার বাড়িতে থাকা তিন জন শয্যাশায়ী বয়স্কের আক্রান্ত হওয়ার ভয়কে জয় করেই করোনাকে দুর্মুষ করে ফিরেছি। তবে লড়াই এখনও জারি রয়েছে। যার মধ্যে মনের জোর ধরে রাখার লড়াই সব থেকে বড়। কারণ, আমি পারলেও সম্প্রতি আমার এক আত্মীয় করোনা থেকে ফিরতে পারেননি। গভীর শোকের এই মুহূর্তেও মনে হচ্ছে, হার মানলে চলবে না। শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হবেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাই হচ্ছেও।

আমহার্স্ট স্ট্রিটে আমাদের দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি। এক মেয়ে সুমেধা, স্কুলে পড়ায়। উত্তর কলকাতার হরি ঘোষ স্ট্রিটে স্বামী আর এক মাত্র মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। আমার ছেলে সুব্রত মুকুন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী। বৌমা অনুরাধাও ইএম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করে। ছেলে-বৌমা আর আমরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও এ বাড়িতেই থাকেন আমার ৯৩ বছরের দাদা বিষ্ণু গুপ্ত ও তাঁর ছিয়াশি বছরের স্ত্রী ইলা। তাঁদের এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

দু’বছর হল দাদার ক্যানসার ধরা পড়েছে। এখন শয্যাশায়ী। বৌদিও বয়সজনিত কারণে একেবারে শয্যাশায়ী। ওঁদের দেখভালে এক জন থাকলেও আমাদের উপরেই অনেকটা নির্ভরশীল ওঁরা। আমার স্ত্রী বছর আটষট্টির উপাসনাও গত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবিটিসের কারণে শয্যাশায়ী। খুব প্রয়োজনে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। তার মধ্যে পড়ে আঘাত পাওয়ায় তাঁর একটি হাতে প্লেট বসানো। দিনে অন্তত ১৬টা ওষুধ তাঁকে খাওয়াতে হয় আমাকেই। গত বছর মার্চে আমার হার্নিয়ার অস্ত্রোপচার হয়। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরেও ওই অবস্থাতেই তিন জনকে দেখতে হচ্ছিল আমায়। এর মধ্যেই করোনার বিপদ!

গত জুনের ১৪ তারিখ হঠাৎ জ্বর আসে আমার। ছেলে করোনার পরীক্ষা করাতেই রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। প্রথম কয়েক দিন সে ভাবে টের পাইনি। কিন্তু জ্বরটা কিছুতেই যাচ্ছিল না। টানা পাঁচ দিন ওই রকম জ্বর থাকার পরে শুরু হল শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যাওয়া। কখনও ৮৯ তো কখনও ৮২! বাড়িতে তিন জন শয্যাশায়ী। ঝুঁকি না নিয়ে ২০ জুন আমায় মেডিকা হাসপাতালে ভর্তি করানো হল। পিপিই কিট পরে লোকজন এলেন আমায় নিতে। সে এক ব্যাপার বটে। তখন করোনা নিয়ে মানুষের ছুঁৎমার্গ আরও অনেক বেশি ছিল। আমায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দেখতে লোক জড়ো হয়ে গেল। দ্রুত আইসিইউ-তে ঢোকানো হল। শরীরে তখন আরও বেশি অক্সিজেন চাইছে। দু’দিন পরে অবশ্য অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করল। ফেলে রাখলে সংক্রমণ আবার বেড়ে যেতে পারে এই ভেবে ছ’দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে নেওয়া হয়।

বাড়ি এসে শুরু হল আরেক লড়াই। তত দিনে মেয়ে আর নাতনি আমাদের বাড়ি চলে এসেছে। জামাই বাজার করে দিয়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেল, আমার আটষট্টি বছরের স্ত্রী, নাতনি আর দু’জন কাজের লোকের করোনা পজ়িটিভ। চিকিৎসা শুরু হলেও তাঁদের অবশ্য তেমন বাড়াবাড়ি হয়নি। বাড়ির বাইরের দিকের একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। আমার স্ত্রীর ওষুধপত্র সব আমিই দিতাম। সেগুলো তাই বৌমাকে বুঝিয়ে দিতে হল। আমার তখন ঘরবন্দি অবস্থা। কোনও মতে শৌচকর্ম সেরেই ঘরে ঢুকে পড়তে হত। ১৭ দিন ওই ভাবে থাকার পরে করোনা সারল।

এখন কিন্তু মনে হয়, ভাগ্যিস ছেলে-বৌমা আর মেয়ের কথা মতো নিয়ম মেনেছিলাম! বরাবরই আমার মনের জোর বেশি। করোনার সময়ে সেটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

সেই মনের জোর একটু ধাক্কা খেল সম্প্রতি আমার এক আত্মীয়ের করোনায় মৃত্যুর পরে। তার পরিবারেও অনেকেই আক্রান্ত। প্রথমে মনে হয়েছিল, এর পর আর আমার ফিরে আসার কাহিনি বলে কী হবে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বলা দরকার। সকলকে বোঝাতে চাই, এই কঠিন সময় কেটে যাবে। শুধু নিজের উপর ভরসা রাখতে হবে। ৮৩ বছরের আমি তিন শয্যাশায়ীকে সামলে করোনাকে আউট করে ক্রিজ়ে থাকতে পারলে, আপনারা পারবেন না?

COVID-19 coronavirus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy