প্রকাণ্ড ঘরে চোখ ধাঁধানো অন্দরসজ্জা। হোম থিয়েটার, ওয়াইফাই, ল্যাপটপ, রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোওয়েভ আভেন, গদিআঁটা সোফা থেকে শুরু করে মাসাজ চেয়ার, এমনকি সব সময়ের সহায়ক— কী নেই! কোনওটি ‘মহারাজা সুইট’, তো কোনওটির নাম ‘প্রেসিডেনশিয়াল সুইট’।
বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে হলে শুধু ফোন তুলে বলার অপেক্ষা। শেফ নিজে রান্না করে নিয়ে আসবেন। শপিং, শহর ঘোরা বা স্পা-য়ের জন্য যেতে চাইলে চলে আসবে চালক-সমেত দামি গাড়ি। স্থানীয় ভাষা বুঝতে অসুবিধে হলে অনুবাদকের ব্যবস্থা করা হবে।
এ পরিষেবা পাঁচতারা হোটেলের নয়, হাসপাতালের!
কলকাতার বিভিন্ন কর্পোরেট হাসপাতাল এখন এমন বিলাসবহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হাজির। কারণ, দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো এ শহরের এখন তারা মোটা টাকার বিনিময়ে পাঁচতারা স্বাস্থ্য পরিষেবা কেনার ‘এলিট’ ক্রেতা পাচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবসা করতে এসেছে। তারা এই ক্রেতা হারাতে নারাজ।
হাসপাতাল শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত এক প্রবীণ কর্তার কথায়, ‘‘হাসপাতালে আমরা মধ্যবিত্তদের জন্য যেমন ঘর রাখছি, তেমন অতি-উচ্চবিত্তদের কথাও আলাদা করে ভাবতে হবে। কেউ যদি হাসপাতালে দৈনিক ২০ হাজার টাকার ঘরে থাকতে চান, ব্যবসা করতে এসে তাঁকে ফেরাব কেন? কলকাতায় তেমন ক্রেতা এখন আছেন।’’ চিকিৎসা পরিষেবার কাজের সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, ‘মেডিক্যাল টুরিজ়ম’ চাঙ্গা করতেও এই ‘পাঁচতারা পরিষেবা’ জরুরি। নয়তো বিদেশিরা আসবেন কেন?
দিল্লির বেশ কিছু নামী হাসপাতালে দৈনিক ২৫,০০০ থেকে ৩৭,০০০ টাকার সুইট বেশ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে। গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে জাকুজ়ি, স্পা, ৪০ আসনের প্রাইভেট সিনেমাহল, শপিং মল পর্যন্ত আছে। কলকাতা এতটা এগোতে না-পারলেও এখানেও এখন হাসপাতালে দৈনিক ১৬,০০০ বা ২৫,০০০ টাকার সুইটে জায়গা পেতে লাইন পড়ছে। ‘কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান রূপক বরুয়া বলছেন, ‘‘ঠিক এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের কর্পোরেট হাসপাতালগুলি চিকিৎসার খরচ বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল। লিখিত ভাবে সে কথা স্বাস্থ্য কমিশনে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু খরচ বেঁধে দিলে এই ‘এক্সক্লিউসিভ’ পরিষেবা দেওয়া অসম্ভব। মেডিক্যাল ট্যুরিজম তাতে ধাক্কা খাবে।’’
কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালের ‘প্রেসিডেনশিয়াল সুইট’-র দৈনিক ভাড়া ২৫,০০০ টাকা। হাসপাতাল সূত্রে খবর, মূলত ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন কিংবা সংস্থার উঁচু পদে কর্মরতেরা এতে থাকছেন। রোগীর ঘরে হোম থিয়েটার, ওয়াইফাই, ল্যাপটপ, প্যানট্রি থেকে শুরু করে মাসাজ চেয়ার, সবই আছে। পাশে আছে পরিজনেদের ঘর। ঘরের বাইরে সব সময়ের সহায়ক দাঁড়িয়ে থাকেন। যে কোনও দরকারে তাঁকে ডাকা যায়। রোগীকে বিমানবন্দর থেকে আনা-নেওয়া, রোগীর আত্মীয়েরা চাইলে বিশেষ এসকর্ট ও গাড়ি দিয়ে তাঁদের কলকাতা ঘোরানো, শপিংয়ের ব্যবস্থাও করে হাসপাতাল। প্রতিদিন শেফ এসে রোগীর কী খেতে ইচ্ছে করছে, তা জেনে রান্না করেন।
আরও পড়ুন: তৃতীয় ব্যক্তির হাতে চাবি কেন, ধন্দে পুলিশ
আমরি হাসপাতালের মুকুন্দপুর ক্যাম্পাসে রয়েছে দৈনিক ২০,০০০ টাকার ‘রয়্যাল সুইট’। হাসপাতালের দাবি, মাসে ১৮-২০ দিন তা ভর্তি থাকে। তাঁরাও রোগীর সঙ্গীদের শহর ঘোরা বা শপিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। এ ছাড়াও হাসপাতালে রয়েছে ‘শোক পালনের ঘর।’ কোনও রোগীর মৃত্যু হলে আত্মীয়েরা সেই ঘরে একান্তে সময় কাটাতে পারেন।
কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালের বিশেষ সুইটের দৈনিক ভাড়া ১৬,০০০। অন্য সব সুবিধার সঙ্গে এখানে ক্রকারি ও কার্টলারি সেটের ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া হয় বলে জানান কর্তৃপক্ষ। থাকেন সব সময়ের সহায়ক। ফর্টিসের ‘রয়্যাল সুইট’-এর দৈনিক ভাড়া আবার ১৩৫০০। সেখানে রোগীদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য বিশেষ ‘টেরাস গার্ডেন’ রয়েছে। বেলভিউ-এর দৈনিক ১৪,০০০ টাকার স্যুইটেও রয়েছে সাচ্ছন্দ্যের যাবতীয় উপকরণ। কর্তৃপক্ষ জানালেন, হাসপাতালের নতুন ভবনে জাকুজ়ি, স্পা-এর ব্যবস্থাও করবেন। কারণ, তার চাহিদা রয়েছে।
বিত্তবান রোগীদের চাহিদার কথা বুঝে পিছিয়ে থাকতে চাইছে না সরকারি হাসপাতালও। এক সময় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে দৈনিক ৩০০ বা ৪০০ টাকার বিনিময়ে থাকার জন্য কিছু কেবিন থাকত।
মাঝে তা তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ক্রমশ সরকার বুঝতে পারছে, উচ্চ-মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত রোগীদের একাংশ একটু ভাল কেবিন পেলে টাকা দিয়েই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসায় ইচ্ছুক। তাতে সরকারি হাসপাতালের ভাঁড়ারে কিছু টাকাও জমা পড়বে যা হাসপাতালের পরিকাঠামো ঠিক রাখায় ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ মাছের তেলে মাছ ভাজা।
অতএব, পাইলট প্রকল্প হিসাবে এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্নে চালু হয়েছে ‘কর্পোরেট লুক’-এর ১৬টি কেবিন। ১০টি-র ভাড়া ২৫০০ টাকা করে আর ৬টির ৪০০০ টাকা। সেখানে এসি ঘরে আধুনিক শয্যা, গদি আঁটা সোফা থেকে দেওয়াল-জোরা রঙিন টিভি, ইন্টারকম, অত্যাধুনিক শৌচাগার, একডাকে হাজির ধোপদুরস্ত ওয়ার্ডবয়—সব মজুত। মার্চের মধ্যে কেবিনের সংখ্যা ৪০ হতে চলেছে। শুধু কেবিনের রোগীদের জন্যই তখন চালু হবে পৃথক প্যান্ট্রি। চিকিৎসার সঙ্গে পাঁচতারা বিলাসিতার মিশেল থাকছে এখানেও।