E-Paper

বেলাগাম ঘৃণা-ভাষণ চলছেই, নিশানায় সংখ্যালঘুরা

সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে খাস কলকাতায় ইসলাম-বিদ্বেষের জেরে এক নবীনা কলেজছাত্রীর আতঙ্ক, দুর্ভোগের কথা উঠে এসেছে। শহরের ব‍্যস্ত রাস্তায় যানজটের জন‍্যস্থানীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছিলেন অ‍্যাপ-ক‍্যাব চালক।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:২১

— প্রতীকী চিত্র।

মাত্র কয়েক দিন আগেই গোটা দেশে নজিরবিহীন একটি আইন পাশ হয়েছে কর্নাটক বিধানসভায়। ঘৃণা-ভাষণ বা ‘হেট-স্পিচ’ দেওয়ার প্রমাণ মিললে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কাগজে-কলমে আইন এবং তা কার্যকর করার মধ‍্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকে। তবু আজকের ভারত বা পশ্চিমবঙ্গেও পর পর যা ঘটে চলেছে, তাতে হেট-স্পিচ বিষয়ক আইন থাকলেতা বিপন্ন, অসহায় শ্রেণিকে কিছুটা হলেও ভরসা জোগাত বলে অনেকে মনে করেন।

সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে খাস কলকাতায় ইসলাম-বিদ্বেষের জেরে এক নবীনা কলেজছাত্রীর আতঙ্ক, দুর্ভোগের কথা উঠে এসেছে। শহরের ব‍্যস্ত রাস্তায় যানজটের জন‍্যস্থানীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করেছিলেন অ‍্যাপ-ক‍্যাব চালক। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করেন মুসলিম মায়ের কন‍্যা সেই ছাত্রী। তিনি নিজের পরিচয়ও দেন তখনই। তাতে পিছু হটেননি সেইচালক। উল্টে, মুসলিম পরিচয়ের জন্য মেয়েটিকে প্রচুর লটবহরসুদ্ধ নেমে যেতে বাধ্য করেন। ন‍্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক‍্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক সরফরাজ আহমেদ খান বলছেন, “মানুষের ভিতরের বিদ্বেষেরনানা কারণ থাকে। কিন্তু আইনি রক্ষাকবচ থাকলে ঘৃণার শিকার অনেকেই খানিকটা সুবিধা পেতেন। নতুন ন‍্যায় সংহিতার আইনের ধারাতেও ঘৃণা-ভাষণকে আমল দেওয়া হয়নি।”

অনেকেই বরং দেখছেন, অনেক দূরে কোনও না কোনও রাজনৈতিক হিংসা বা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলেই সমাজমাধ্যমের একটি প্রভাবশালী অংশ সংগঠিত ভাবে মুসলিম-বিদ্বেষের আখ‍্যান তৈরিতেতৎপর হয়ে ওঠেন। যেমন, সদ‍্য বাংলাদেশে ‘নৃশংস মৌলবাদী কার্যকলাপ’-এর বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রতিবাদ মিছিল বিষয়ক পোস্টে গেরুয়া শিবিরের সমর্থকদের একাংশ তেড়ে এসেছেন। তাঁদের দাবি, কেন সরাসরি মুসলিম মৌলবাদীদের হিন্দু-বিরোধী কার্যকলাপ বলে বিষয়টিকে দেখা হবে না? সেখানেই কেউ কেউ বোঝানোর চেষ্টাকরেছেন, বাংলাদেশের মৌলবাদীদের নিশানায় একই সঙ্গে রবীন্দ্র-সংস্কৃতিপ্রেমী মুসলিম, মাজারগামী মুসলিম, বাউল, গরিব হিন্দু— অনেকেই রয়েছেন। ভারত-বিরোধিতার ধুয়ো তুলে তাঁরা ওই দেশে সংস্কৃতির বহুস্বরই চাপা দিতে চান। ঠিক যেমন, এ দেশে এক ধরনের মুসলিম আগ্রাসনের জুজু দেখিয়ে হিন্দু আধিপত্যবাদকে বৈধতা দেওয়াই অনেকের লক্ষ‍্য।

চিৎকৃত অভিযোগ, হুমকির জোরে সমাজমাধ‍্যমে এ সব যুক্তির কথা আকছার চাপা পড়ে যায়। এ বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হোমবাউন্ড’ ছবিটি দেখিয়েছে, মুসলিম নামধারী যুবক বেসরকারি অফিসে পদে পদে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের জন‍্য লাঞ্ছিত হচ্ছেন। খাস কলকাতাতেও আমরা দেখি, মুসলিম পরিচয়ের জন‍্য মফস্সল থেকে আসা ছাত্রী বা ঘর খোঁজা নবদম্পতি ধারাবাহিক ভাবে চরম নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। ভিন্ রাজ‍্যে রুটি-রুজির খোঁজে যাওয়া পরিযায়ীদের নিয়ে গবেষণারত ক‍্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের সমতা বিশ্বাস বলছেন, “ধর্ম নির্বিশেষে গরিব, দুর্বল শ্রেণিই সুযোগ বুঝে বিদ্বেষের শিকার হন। কিন্তু ময়মনসিংহে গণপিটুনির শিকার, শ্রমিক দীপু দাস আর রাজস্থানে একই ভাবে খুন হওয়া মহম্মদ আফরাজুলের পরিণতি নিয়ে এক নিঃশ্বাসে প্রতিবাদ করতে কম জনকে দেখা যায়।” সরফরাজেরও ব‍্যাখ‍্যা, “মায়ানমার, ভারত বা বাংলাদেশ— সর্বত্রই গণপিটুনির মতো অপরাধের নেপথ্যে ঘৃণা-ভাষণের সরাসরি ভূমিকা থাকে।”

সংগঠিত মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচারের পিছনে গেরুয়া শিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আবার পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের বিদ্বেষের উস্কানিতে রাজ‍্যের শাসক দলের ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। মেটিয়াবুরুজে হকারের ডালার পাশে তুলসী গাছ বসিয়ে গোলমাল পাকানোয় শাসক দলের এক নেতারই ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ। আবার ময়দানে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে চিকেন প‍্যাটিস বিক্রেতার নিগ্রহের ঘটনার ভিডিয়ো থাকলেও অভিযুক্তেরা জামিনে বেরিয়ে বীরের সংবর্ধনা পায়। কারও কারও মত, এমন কিছু ঘটনায় রাজ‍্যের শাসক দলও সাম্প্রদায়িক সংঘাতে প্রশ্রয় দেয়। আবার পরে নিজেদেরই বিপন্ন মুসলিম সমাজের ত্রাতা বলে জাহির করতে উঠে-পড়ে লাগে। সংঘাত ও অশান্তির নানা ঘটনায় ধারাবাহিক ক্ষেত্র সমীক্ষায় যুক্ত ‘আমরা সবাই একটি সচেতন প্রয়াস’ গোষ্ঠীর শুভপ্রতিম রায়চৌধুরীর মতে, “সংঘাতের পিছনের রাজনৈতিক খেলাও একটি ভয়ানক প্রবণতা। তা আখেরে সামাজিক সুস্থিতিই টালমাটাল করছে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hate speech Minority Class Minority Vulnerable West Bengal government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy