Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিধির গেরো কাটআউটের কপালে

নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই কার্যত নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত তাঁদের। বাড়ির উঠোন থেকে রাস্তা, সর্বত্রই ছড়িয়ে থাকত ওই শিল্পীদের কাজ। ব্যবসার রমরমায় অর্থের সংস্থানও মন্দ হত না।

ভোটের আয়ে ভাটা। অগত্যা অন্য কাজে হাত। — শুভাশিস ভট্টাচার্য

ভোটের আয়ে ভাটা। অগত্যা অন্য কাজে হাত। — শুভাশিস ভট্টাচার্য

সুপ্রিয় তরফদার
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:২৯
Share: Save:

নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই কার্যত নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত তাঁদের। বাড়ির উঠোন থেকে রাস্তা, সর্বত্রই ছড়িয়ে থাকত ওই শিল্পীদের কাজ। ব্যবসার রমরমায় অর্থের সংস্থানও মন্দ হত না। কিন্তু এই বছর পরিচিত হিসেবটাই কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের কাজের অর্ডার প্রায় নেই, সংসারের ভাঁড়ারেও পড়েছে ভাটার টান। তাই প্রতিবারের কর্মব্যস্ত শিল্পীদের এ বার হাত প্রায় খালি। ভোটের সময়টাও যে কাটতে পারে কাজের অপেক্ষায়, খানিকটা যেন অবাকই তাঁরা।

রাজ্যে যে কোনও নির্বাচন এলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীকের কাটআউট-পোস্টার তৈরির কাজ পান উত্তর কলকাতার রামবাগান এলাকার শিল্পীরা। তৃণমূল থেকে সিপিএম, কংগ্রেস থেকে বিজেপি, এমনকী নির্দলেরাও— সকলে ওঁদের কাছেই যায়। সব দলই প্রতীক তৈরির কাজ দেয় ওই শিল্পীদের। বেলেঘাটার এক এজেন্সির থেকে অসমের তলতা, মূলি ও জা প্রকৃতির বাঁশ কিনে এনে তার উপরে কাগজ সেঁটে তৈরি করেন বিভিন্ন দলীয় প্রতিকৃতি। তৃণমূলের জোড়াফুল থেকে বিজেপি-র পদ্মফুল, তলতা বাঁশের অংশ দিয়ে তাঁরাই গড়ে তোলেন একের পর এক দলের প্রতীক। প্রথমে বাঁশের অংশে কাগজ সাঁটিয়ে, তার উপরে ফের কাপড়ের প্রলেপ। এর পরে সেখানে রং-তুলির কারুকার্যে ফুটে উঠত ১২-১৪ ফুটের বড় বড় কাটআউট।

কিন্তু এ বছর কাজের অর্ডারে রীতিমতো ভাটার টান লক্ষ্য করেন শিল্পীরা। আশা ছিল, পরিস্থিতি আগের মতোই হয়ে যাবে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, ততই দেখা গিয়েছে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আগে নির্বাচনে প্রায় আট হাজার কাজের বরাত পেতেন শিল্পী সুভাষ পোড়েল। কিন্তু এ বছর সেই অর্ডারের সংখ্যা এসে ঠেকেছে মাত্র দু’শোয়। তার মধ্যে তৃণমূলেরই ১২০টি। বামেদের তো প্রায় নেই। বিজেপি ও কংগ্রেসের রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি।

সুভাষবাবু জানান, গত বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচনেও কাটআউটের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু এ বছর প্রথম থেকেই বাজার মন্দা। তিনি বলেন, ‘‘অন্য বার নির্বাচনের সময়ে প্রায় ২৫ জনকে কাজে লাগিয়েও কাজ শেষ হয়ে উঠত না। কিন্তু এ বার নির্বাচনের তেমন কোনও কাজই নেই। অন্নপ্রাশনের বাড়ি সাজানোর কাজ করতে হচ্ছে।’’ আর এক কর্মী জানান, অন্নপ্রাশন থেকে বিয়েবাড়ি, পুজো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মণ্ডপসজ্জা— সব ধরনের অর্ডারই পান তাঁরা। থার্মোকল ও বাঁশের কাজই মূলত করে থাকেন। গোটা বছর ধরে এলাকার পারিবারিক ব্যবসা এটিই। কিন্তু এত দিন নির্বাচনের জন্যেই গোটা বছর অপেক্ষা করতেন তাঁরা। কারণ কোনও নির্বাচনের সময়ে প্রায় সারা বছরের সমান আয় করতেন ওই এলাকার শিল্পীরা। কিন্তু এ বছর হাতে গোনা কয়েকটি টাকা ঘরে তুলতে পেরেছেন। অন্য এক শিল্পী বলেন, ‘‘বেলেঘাটার এক তৃণমূল প্রার্থী ১২ ফুট লম্বা দলীয় প্রতীকের অর্ডার দিয়েছেন। অর্ধেক টাকাও দিয়ে গিয়েছেন। কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু তিনি আর নিয়ে যাচ্ছেন না।’’

বাজার খারাপ ফেস্টুনেরও। আর এক শিল্পী মন্টু পাত্র বলেন, ‘‘ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে প্রায় সমস্ত নির্বাচনে ফ্লেক্সের অর্ডার পেতাম। কিন্তু এ বারে হাতে গোনা কয়েকটি পেয়েছি। কামারহাটিতে মদন মিত্রের ২০ ফুটের ফ্লেক্স থেকেই যা আয় হওয়ার হয়েছে।’’

কিন্তু কেন এই অবস্থা? উত্তর দিচ্ছেন নিজেরাই। শিল্পী দীপক পাকড়ের কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশন রাস্তায় কাটআউট লাগাতে দিচ্ছে না। কোনও দেওয়ালেও ফ্লেক্স লাগানো নিয়ে অনেক নিয়মের বেড়াজাল। তাই রাজনৈতিক দলগুলি এ বার আর কাজের অর্ডার দেয়নি।’’

নির্বাচন কমিশন এই বছর নিয়ম করেই দিয়েছে কোনও সরকারি জায়গায় নির্বাচনের ফ্লেক্স বা কাটআউট লাগানো যাবে না। বেসরকারি দেওয়ালেও তা লাগাতে হলে অনুমতির প্রয়োজন। এই সমস্ত ঝক্কি পোহানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলিই কাটআউট আর চাইছে না বলে মত শিল্পীদের। প্রার্থীর সঙ্গে হাঁটার জন্য কিছু দলীয় প্রতীকের অর্ডার এসেছে। প্লাইউডের তৈরি সেই সব প্রতীকই এ বছর তাঁদের শিল্পের একমাত্র নমুনা।

কী বলছেন রাজনৈতিক নেতারা?

বিজেপি-র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ শিল্পীদের সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের কড়াকড়ির জন্যই ফেস্টুন, কাটআউট ব্যবসা মার খাচ্ছে। অত ঝক্কির কারণেই আমরা কাটআউটের অর্ডার তেমন একটা দিইনি।’’ তৃণমূলের প্রার্থী পরেশ পালও বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের জন্য কোথাও কাটআউট লাগানোর উপায় নেই। তাই গরিব শিল্পীরা কাজের অর্ডারও পাচ্ছেন না।’’ কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বর্তমানে প্রচারের ধারাও বদলে গিয়েছে। এখন অন্য রকমের প্রচার চলছে। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন ফ্লেক্স, ফেস্টুন ও কাটআউটের যে পরিমাণ খরচ ধরে, তাতে এ সব তৈরি করতে হলে খরচ অনেকটা বেড়ে যায়।’’ রাজ্য কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথাতেও একই সুর। বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন যে ভাবে কড়াকড়ি করেছে, তার ফলে কাটআউটের রাস্তা থেকে সরতে হয়েছে।’’ সিপিএম নেতা অনাদি সাহু বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের বিধি-নিষেধ তো রয়েছেই। তার উপরে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ফেসবুকের মাধ্যমেও প্রচার চালানো হচ্ছে। লিফলেট এবং স্টিকারও রয়েছে প্রচারের তালিকায়।’’

ভোট আসবে, ভোট চলেও যাবে। প্রচারের নতুন মাধ্যম বেছে নেবে রাজনৈতিক দলগুলি। তবু কিছু বিধি-নিষেধে বদল আসার আশায় থাকবে শিল্পীদের এই পাড়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election code of conduct Cutout
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE