Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মা বেঁচেই, জামাই-মেয়ের কীর্তি ফাঁস

মা ‘মারা গিয়েছেন’ জানিয়ে পাড়ার লোকের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মায়ের শ্রাদ্ধশান্তিও সেরে ফেলেছিলেন মেয়ে-জামাই। ‘মৃত’ সেই মা-ই বাড়ি ফিরে এলেন পাশের পাড়ার এক মহিলার হাত ধরে! কী ভাবে ফিরলেন মা? পাশের পাড়ার এক মহিলা তাঁর আত্মীয়কে দেখতে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানকার ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডের শৌচাগারের পাশে এক বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন তিনি। দিন কয়েক আগে ওই বৃদ্ধারই শ্রাদ্ধের কথা শুনেছিলেন যে!

আপেলরানি। —নিজস্ব চিত্র।

আপেলরানি। —নিজস্ব চিত্র।

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:৪৮
Share: Save:

মা ‘মারা গিয়েছেন’ জানিয়ে পাড়ার লোকের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মায়ের শ্রাদ্ধশান্তিও সেরে ফেলেছিলেন মেয়ে-জামাই। ‘মৃত’ সেই মা-ই বাড়ি ফিরে এলেন পাশের পাড়ার এক মহিলার হাত ধরে!

কী ভাবে ফিরলেন মা? পাশের পাড়ার এক মহিলা তাঁর আত্মীয়কে দেখতে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানকার ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডের শৌচাগারের পাশে এক বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন তিনি। দিন কয়েক আগে ওই বৃদ্ধারই শ্রাদ্ধের কথা শুনেছিলেন যে! তা হলে তাঁকে হাসপাতালে দেখছেন কী ভাবে? বছর সত্তরের ওই বৃদ্ধা তত ক্ষণে তাঁকে দেখে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। ওই মহিলা বাড়ি ফিরে এসে পাড়ায় গোটা বিষয়টি জানান। তখন পাড়ার বাসিন্দারা মেয়ে-জামাইকে চেপে ধরতে জানা যায়, পরিকল্পনা করেই মাকে তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি করার সময়ে ভুল ঠিকানা দিয়ে এসেছিলেন, যাতে হাসপাতাল তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে। ওই বৃদ্ধাকে ভর্তি করে আসার পরে তাঁর আর খোঁজও নেননি ওই দম্পতি।

ঘটনাটি ঘটেছে বাগুইআটির প্রতিবেশী পাড়ায়। হতদরিদ্র ওই পরিবারের জামাই জগন্নাথ পাল দমদম পার্ক বাজারে মাছ বিক্রি করেন। জগন্নাথ ও তাঁর স্ত্রীর চার ছেলেমেয়ে। পরিবারে তিনিই একমাত্র রোজগেরে। শাশুড়ি আপেলরানি পালের সেরিব্রাল অ্যাটাকের পরে জগন্নাথ তাঁকে আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। তার কয়েক দিন পরে ওই দম্পতি পাড়ায় রটিয়ে দেন, বৃদ্ধা মারা গিয়েছেন। স্বভাবতই বিষয়টিতে কেউ কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেননি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, আর জি করের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে বারবার ওই বৃদ্ধার ঠিকানার খোঁজ করা হয়েছিল। কিন্তু জগন্নাথবাবুরা ভুল ঠিকানা দেওয়ায় বাড়ির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই ফাঁড়ির অফিসার জয়দেবকুমার দে বলেন, “বৃ্দ্ধার ঠিকানা বাগুইআটির দেখে আমরা বাগুইআটি থানার সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু বাগুইআটি থানা বৃদ্ধাকে খুঁজে বার করতে পারেনি। বাগুইআটির যে পাড়ার কথা ঠিকানায় বলা ছিল, সেই ঠিকানায় গিয়ে পুলিশ কোনও খোঁজ পায়নি।” এর পর থেকে ওই বৃদ্ধা হাসপাতালের শৌচাগারের পাশের বারান্দাতেই দিন গুজরান করছিলেন।

পাড়ার লোকজনের কাছে জগন্নাথ দাবি করেছেন, হাসপাতাল থেকেই তাঁকে তাঁর শাশুড়ির মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হল, তা হলে কেন তিনি শাশুড়ির মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে নেননি? কেনই বা ডেথ সার্টিফিকেট দেখতে চাননি? স্বপ্না দত্ত নামে বাগুইআটির বাসিন্দা যে মহিলা হাসপাতালে ওই বৃদ্ধাকে প্রথম দেখতে পান ও বাড়ি খুঁজে বার করেন, তাঁর এ সব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি জগন্নাথ। শুধু বলেছেন, “আমার এক মেয়ে ও জামাই আমাকে খবরটা দিয়েছিল। আমি অবিশ্বাস করিনি।”

স্বপ্নাদেবীর সহযোগিতায় আপেলরানির সন্ধান পাওয়ার পরে শাশুড়িকে শুক্রবার রাতে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন জগন্নাথ। ওই বৃদ্ধা বাড়ি ফিরে আসার পরে অবশ্য হতদরিদ্র ওই পরিবারের পাশেই দাঁড়িয়েছে পাড়া। স্থানীয় প্রতিবেশী ক্লাবের সভাপতি অপূর্ব সেনগুপ্ত বলেন, “পরিবারটি খুবই গরিব। ওরা যদি আমাদের এসে বলত যে, মায়ের চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য কিছু সাহায্যের দরকার, আমরা তা তুলে দিতাম। কিন্তু ওরা আমাদের তেমন কিছু বলেনি। বরং বলেছে, মা মারা গিয়েছে। শ্রাদ্ধশান্তির জন্য সাহায্য দরকার। আমরা চাঁদা তুলে ওদের সাহায্য করি। ওরা যে মাকে হাসপাতালে ফেলে চলে এসেছে, তা আমরা এক বারের জন্যও ভাবতে পারিনি।” আর জি কর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এই ধরনের ঘটনা এর আগেও বেশ কয়েক বার ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে তবু ওই বৃদ্ধা বাড়ি ফেরার সুযোগ পেলেন। অনেকে তা-ও পান না। হাসপাতালেই তাঁদের মৃত্যু হয়।

প্রতিবেশী পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “খুবই গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ওই বৃদ্ধা। পরিবারটি এতই দরিদ্র যে, আমরা ভেবেছিলাম হয়তো বা টাকাপয়সার অভাবের জন্যই ওই বৃদ্ধা মারা যাওয়ার পরে হাসপাতাল থেকে সরাসরি শ্মশানঘাটে গিয়ে তাঁকে দাহ করে চলে এসেছে। আমরা ভাবতেই পারিনি যে, উনি বেঁচে আছেন।”

ওই পাড়ার সূত্রে জানা গিয়েছে, আপেলরানি এক বছর আগেও বিভিন্ন বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন। পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করতেন তিনি। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য এখন আর কিছু করতে পারেন না। বাড়িতেই থাকেন। ফলে জগন্নাথ ছাড়া ওই বাড়িতে উপার্জনকারী এখন আর কেউ নেই।

তবে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আপেলরানি এখন খুশি। অসুস্থ ওই বৃদ্ধাকে অবশ্য তাঁর শ্রাদ্ধশান্তির বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। তিনি বলেন, “বাড়ি ফিরতে পেরে আমি খুশি। মেয়ে-জামাই অনেক দিন খোঁজ নেয়নি ঠিকই, কিন্তু ওরাই তো আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনল। আর পুরনো কথা মনে রাখতে চাই না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE