কোনও অপরাধস্থলে ফরেন্সিক তদন্তকারী দল পৌঁছচ্ছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পাঁচ-সাত দিন পরে। কোথাও আবার লেগে যাচ্ছে দিন পনেরোরও বেশি সময়! অভিযোগ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাসের পর মাস কেটে যাওয়ার পরেও ফরেন্সিক তদন্তকারীরা আসছেনই না। যে থানার ঘটনা, সেই থানা থেকে রিকুইজ়িশন (তদন্তকারী পাঠানোর আবেদন করে জমা দেওয়া কাগজ) দেওয়ার পরেও কেন কেউ আসেননি, খোঁজ করতে গেলে জানা যাচ্ছে, ফরেন্সিক কর্তারা ঠিক করে দিয়েছেন, সেখানে যাওয়ারই প্রয়োজন নেই। রিকুইজ়িশন কাগজের উপরে যে ‘নট নিডেড’ (অপ্রয়োজনীয়) লিখে ফেলে রেখে দেওয়া হয়েছে, তা জানেই না থানা! এ দিকে, ফরেন্সিক তদন্তকারীদের অপেক্ষায় দিনের পর দিন অপরাধস্থল ঘিরে রাখা হচ্ছে, তদন্তের কাজ এগোচ্ছে না বলে পিছিয়ে যাচ্ছে চার্জশিট লেখার কাজও! যিনি ভুক্তভোগী,তিনি বা তাঁর পরিবার ঘুরেই চলেছেন থানায়! উত্তর পাচ্ছেন না, কবে মামলা আদালতে উঠবে। ঘুরছে অভিযুক্তের পরিবারও।
‘স্টেট ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’র কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি এখন এমনই। তাঁদের দাবি, ‘‘যে কোনও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরের কয়েক ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খুন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে যত দেরি হয়, ততই প্রমাণ নষ্টের ঝুঁকি বাড়ে। দেরি করে গেলে এমনও হয় যে, কোনও প্রমাণই পাওয়া যায় না। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনার তদন্তে ফরেন্সিক রিপোর্ট অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই ক্ষেত্রে গাফিলতি হলে পুলিশের পক্ষে মামলা দাঁড় করানোও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকের অভাবে বহু ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বহু তদন্তেই মিলছে না যথাযথ পরিণতি।’’
১৯৫২ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তৈরি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির জন্য ১৯৫৭ সালে বেলগাছিয়ায় আলাদা অফিস তৈরি হয়। স্টেট ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি নামে সেখান থেকেই এর পরে কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালে দ্রুত কাজের জন্য ফরেন্সিক কুইক রেসপন্স দল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। কলকাতা, বিধাননগর এবং হাওড়ার জন্য তৈরি হয় মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিট। দক্ষিণবঙ্গের জন্য দুর্গাপুরে এবং উত্তরবঙ্গের জন্য জলপাইগুড়িতে তৈরি হয় রিজিয়োনাল ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি। ২০২০ সালে এর পরে আলাদা করে ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন তৈরির সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয় সরকার। স্টেট ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির এক কর্মীর কথায়, ‘‘ব্যারাকপুর, আসানসোল-দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি এবং চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটে একটি করে এবং সিআইডি-র জন্য একটি ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও একটিও ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন কাজ শুরু করতে পারেনি। উল্টে ঘটনাস্থল পরিদর্শন কমিয়ে পুলিশের পাঠানো অপরাধের সঙ্গে জড়িত জিনিসপত্র পরীক্ষা করেই কাজ সারার ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে।’’
আরও এক সমস্যার কথা জানালেন বিধাননগর মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের এক কর্মী। নিউ টাউন থানা থেকে কখন গাড়ি পাঠানো হবে, সেই অপেক্ষায় থাকাকালীন ওই কর্মী বললেন, ‘‘এমনটা হওয়ারই কথা নয়। রাজ্য সরকার ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহের জন্য চারটি গাড়ি দিয়েছিল। উত্তর ও মধ্য কলকাতার জন্য একটি গাড়ি, দক্ষিণের জন্য একটি। এ ছাড়া, বিধাননগর এবং হাওড়াকে দেওয়া হয়েছিল একটি করে গাড়ি। কিন্তু কলকাতার মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি কলকাতার গাড়িটি নিয়ে প্রথমে বিধাননগর চলে যান। পরে বদলি হয়ে ব্যারাকপুরে চলে গিয়েছেন। আবার বিধাননগরে যিনি ছিলেন, তিনি বিধাননগরের গাড়িটি নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছেন। একেবারে ব্যক্তিগত গাড়ির মতো করে ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলি। আর আমাদের নমুনা সংগ্রহে যাওয়ার জন্য পুলিশের পাঠানো গাড়ির উপরে ভরসা করতে হচ্ছে! সেই গাড়ি নিয়ে প্রথমে অফিসে গিয়ে নমুনা সংগ্রহের কিট নিতে হচ্ছে। এর পরে ঘটনাস্থল ঘুরে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষাগারে রাখতে যেতে হচ্ছে। তার পরে আবার যেখান থেকে কিট এনেছিলাম, সেখানে গিয়ে কিট রাখতে হচ্ছে। কিন্তু থানা এত সময়ের জন্য গাড়ি দিতে চাইছে না।’’
কেন ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহকারী দলের ঘটনাস্থলে যেতে দেরি হচ্ছে? কেন গাড়ির এমন অনিয়ম চলছে? কেন সরকার সিলমোহর দেওয়ার পাঁচ বছর পরেও ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের কাজ শুরু করা গেল না? স্টেট ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কে জয়রমন বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। স্বরাষ্ট্র দফতর এ ব্যাপারে উত্তর দিতে পারবে।’’ স্বরাষ্ট্র দফতরের কোনও কর্তা অবশ্য এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁদের ইঙ্গিত, দ্রুত কর্মী নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা চলছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)