Advertisement
E-Paper

টানা পাঁচ বছর ডাকযোগে প্রাচীন সাধনার পাঠ দেবযানীর

শরীর-মন-আত্মা— এই তিন নিয়ে প্রাচীন যোগ সাধনায় নিজেকে রপ্ত করে তুলেছিলেন রবিনসন স্ট্রিটের বছর সাতচল্লিশের দেবযানী দে। দু’দিন আগে নিজের বাড়ি থেকে যাঁর ছ’মাস পুরনো কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে বলে ভাই পার্থর দাবি। বি-টেক পাশ দেবযানী একাধিক নামী স্কুলে গান শেখাতেন। কিন্তু ওই প্রাচীন যোগ সাধনা শেখার জন্য দক্ষিণেশ্বরের ‘যোগদা সৎসঙ্গ সঙ্ঘে’র সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। শনিবার দক্ষিণেশ্বরের ওই আশ্রম ঘুরে জানা গেল, টানা পাঁচ বছর ধরে ডাকযোগে তাদের যোগ পদ্ধতি শিখেছিলেন দেবযানী।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০৩:২৫

শরীর-মন-আত্মা— এই তিন নিয়ে প্রাচীন যোগ সাধনায় নিজেকে রপ্ত করে তুলেছিলেন রবিনসন স্ট্রিটের বছর সাতচল্লিশের দেবযানী দে। দু’দিন আগে নিজের বাড়ি থেকে যাঁর ছ’মাস পুরনো কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে বলে ভাই পার্থর দাবি। বি-টেক পাশ দেবযানী একাধিক নামী স্কুলে গান শেখাতেন। কিন্তু ওই প্রাচীন যোগ সাধনা শেখার জন্য দক্ষিণেশ্বরের ‘যোগদা সৎসঙ্গ সঙ্ঘে’র সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। শনিবার দক্ষিণেশ্বরের ওই আশ্রম ঘুরে জানা গেল, টানা পাঁচ বছর ধরে ডাকযোগে তাদের যোগ পদ্ধতি শিখেছিলেন দেবযানী। ইতিমধ্যেই এই সংক্রান্ত ১৮২টি বই পাওয়া গিয়েছে তাঁর বাড়িতে।

রবিনসন স্ট্রিটের দে-বাড়ির কঙ্কাল রহস্য উদ্ঘাটনে নেমে তদন্তকারীদের হাতে রোজ নানা তথ্য উঠে আসছে। আবার বহু কথা জানা যাচ্ছে দেবযানীর সহপাঠীদের কাছ থেকেও। যেমন, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে রেডিওফিজিক্স নিয়ে বি-টেক পড়ার সময়ে তাঁর সহপাঠী জয়দেব হালদার জানিয়েছেন আধ্যাত্মিক বিষয়ে দেবযানীর গভীর আগ্রহের কথা। তিনি বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তনী জেনে এক দিন কী ভাবে প্রায় জোর করে মিশনে গিয়ে মহারাজদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন দেবযানী, সেই গল্প শুনিয়েছেন জয়দেববাবু।

রবিনসন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ‘গুরুজি’র জন্য তৈরি একটি গানের সিডি উদ্ধার করে পুলিশ। একাধিক ডায়েরিও উদ্ধার হয়, যার একটিতে ২০১৩-র জুনে দেবযানী লিখেছিলেন, ‘আজ আমার নতুন জন্ম হল। গুরুজিকে কিছু একটা দিতে পারলাম।’ কোথাও লিখেছেন, ‘আমার জীবনের মোড় অন্য দিকে ঘোরানো দরকার।’ বাড়িতে নরকঙ্কালের পাশ থেকে এক সন্ন্যাসীর ছবি ও বই পেয়েছিল পুলিশ। আশ্রম সূত্রের বক্তব্য, সেই সন্ন্যাসী হলেন যোগদা সৎসঙ্গ আশ্রমের পরমহংস যোগানন্দ। ডায়েরিতে দেবযানী ‘গুরুজি’ বলতে তাঁকেই বুঝিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। দে পরিবারের ঘর থেকে যে সব ধর্মীয় বই পেয়েছে পুলিশ, তার অধিকাংশই এই যোগদা আশ্রমের। যোগ সাধনার সময় ওই বইগুলি দেবযানীকে পাঠানো হয়েছিল ডাকযোগে। সেই সব বই দিদির মৃত্যুর পর ঘরে সাজিয়ে রেখেছিলেন পার্থ। তবে আশ্রমের এক সন্ন্যাসী জানান, ওই সব বই বাইরের কোনও মানুষকে দেখানো বারণ ছিল।

আশ্রমের পুরনো নথি থেকে জানা গিয়েছে, ১৯৯৭-এর ২৩ এপ্রিল দেবযানী ওই আশ্রমে এসেছিলেন। তখনই তিনি প্রাচীন যোগ সাধনা পদ্ধতি শেখার জন্য পাঁচ বছরের করেসপন্ডেন্স কোর্সে ভর্তি হন। এর তিন বছর পর দেবযানীর বাবা অরবিন্দবাবু, মা আরতিদেবী এবং ভাই পার্থও ওই যোগ সাধনা পদ্ধতি শেখার জন্য নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। দেবযানী মাঝে-মধ্যে আশ্রমে যেতেন। কখনও হাতেকলমে যোগ পদ্ধতি শিখতে, কখনও রবিবারের বিশেষ ধ্যান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আশ্রমের এক প্রবীণ সন্ন্যাসী জানান, ‘‘ওই মহিলা টানা পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করেছিলেন। কিন্তু পরিবারের বাকিরা তা করেননি। তবে দেবযানীকে বছর দশেক আগে শেষ বার দেখা যায় আশ্রমে। তার পর ওই পরিবার আশ্রমের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ রাখেনি।’’

বস্তুত, পার্থ, অরবিন্দবাবু ও আরতিদেবীকে তেমন ভাবে কোনও দিনই আশ্রমে দেখেননি সন্ন্যাসীরা। আশ্রমের পুরনো রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে দেবযানী একটি চিঠি লিখেছিলেন রাঁচির যোগদা আশ্রমে। তিনি চেয়েছিলেন, পরের বছরের (২০০১ সাল) জানুয়ারিতে আশ্রমের গুরু পরমহংস যোগানন্দের জন্মতিথি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তবে শেষ পর্যন্ত দেবযানী বা তাঁর পরিবারের কেউ ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন কি না, মনে করতে পারছেন না আশ্রমিকরা।

কেন এই প্রাচীন যোগ পদ্ধতি শিখতে চেয়েছিলেন দেবযানী ও তাঁর পরিবার? ১৯৮৭ থেকে দক্ষিণেশ্বর আশ্রমের দায়িত্বে থাকা স্বামী শুদ্ধানন্দ গিরির কথায়, ‘‘মানসিক শান্তি, হিংসা থেকে বিরত থাকার জন্যই হয়তো ওঁরা এখানে যোগ পদ্ধতি শিখতে এসেছিলেন।’’ ওই সন্ন্যাসী জানান, শরীর-মন-আত্মার বিকাশ ঘটানোর জন্য ‘সাইকো ফিজিক্যাল’ পদ্ধতিতে এই ‘ক্রিয়া যোগ’ শেখানো হয়। আশ্রমের এ-ও দাবি, এই যোগ রপ্ত করতে পারলে মানুষ বাইরের জগৎ থেকে সরে গিয়ে তার নিজের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে আত্মার দেখা পায়। ঈশ্বরেরও দেখা পায়। এই যোগ সাধনার জন্য ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে ধ্যানে বসতে হয়।

এই জন্যই কি পার্থর জানলা-দরজা সর্বদা বন্ধ থাকত? মা আরতিদেবীর মৃত্যুর পর বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এই প্রাচীন যোগ সাধনাকে অবলম্বন করেই কি নিজেদের মতো জীবন কাটাতেন দেবযানীরা? নাকি শুধু্ মৃতদেহ পচনের গন্ধ আটকাতে এসি চালিয়ে ঘরের ফাঁকফোকর বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন পার্থ? প্রশ্ন অনেক। ব্যাখ্যাও উঠে আসছে অনেক।

যেমন, আশ্রম সূত্রের দাবি, পার্থ যে পুলিশের কাছে বারবার মাদার হাউসে যাওয়ার কথা এবং যিশুর নাম করছেন, তার সঙ্গেও আশ্রমের সম্পর্ক রয়েছে। সন্ন্যাসীদের ব্যাখ্যা, শ্রীকৃষ্ণ ও যিশু— দু’জনের সাধনার পথই এক। তাই আশ্রমে দু’জনকে পাশাপাশি রেখেই পুজো করা হয়। কিন্তু পার্থ কি ‘অন্য ভাবে’ও এই যোগ সাধনাকে কাজে লাগাতেন? ‘দিদি’র কঙ্কাল পাশে রেখে পার্থ তাঁর আত্মাকে ডাকার চেষ্টা করতেন বলে ইতিমধ্যেই তো সন্দেহ করছেন অনেকে।

এই প্রসঙ্গে স্বামী শুদ্ধানন্দ গিরি বলছেন, ‘‘মরা মানুষ নিয়ে এই সাধনা নয়। আমাদের যোগ সাধনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়। এতে অলৌকিক কিছু নেই। ঠিকমতো সাধনা করলে ঈশ্বর প্রাপ্তি হয়। তবে মনে হয়, ওই ব্যক্তি (পার্থ) এই সাধনার সঙ্গে অন্য কিছুকে মিলিয়ে অলৌকিক কিছু করতে চেয়েছিলেন।’’ পার্থর ঘর থেকে হাত-পা ভাঙা কয়েকটি পুতুল উদ্ধারের পরে পুলিশের একাংশও মনে করছে, তিনি ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ কিংবা তন্ত্র সাধনা করতেন। এই ধারণা উড়িয়ে দিচ্ছেন না আশ্রমের সন্ন্যাসীরাও।

abpnewsletters Belur Math Debjani Yogoda Satsanga Sangha Partha Dey Pavlov Mental Hospital Santanu Ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy