Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ফাঁকা পকেট, অর্থ-হীন ছুটির বাজারও

বৈধ নোটের আকাল থাবা বসাল বাঙালির রবিবাসরীয় বিলাসেও। বাঙালির রবিবার মানেই দুপুরে পাত পেড়ে খাসি বা পাঁঠার মাংসের ঝোলভাত। পাঁচশো, হাজার টাকা নোট বাতিলের পরে প্রথম রবিবারে টান পড়ল সেই আয়েশেই।

সুনসান দোকানপাট। সংবাদপত্রে মন বিক্রেতার। রবিবার, বারাসতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

সুনসান দোকানপাট। সংবাদপত্রে মন বিক্রেতার। রবিবার, বারাসতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৭
Share: Save:

বৈধ নোটের আকাল থাবা বসাল বাঙালির রবিবাসরীয় বিলাসেও।

বাঙালির রবিবার মানেই দুপুরে পাত পেড়ে খাসি বা পাঁঠার মাংসের ঝোলভাত। পাঁচশো, হাজার টাকা নোট বাতিলের পরে প্রথম রবিবারে টান পড়ল সেই আয়েশেই। নোটের সঙ্কটে কেউ কেউ মাংসে হাত ছোঁয়াতেই পারলেন না, কেউ বা কিনলেও আর পাঁচটা রবিবারের চেয়ে অনেক কম!

মাংস বিক্রেতা নূর আহমেদ লস্কর জানালেন, গড়ে প্রতি রবিবার তিনি মাংস বিক্রি করেন ৮০ কেজির উপরে। অথচ এ দিনের বিক্রি ৫০ কেজি ছাড়ায়নি। নূরের কথায়, ‘‘যিনি সওয়া কেজি মাংস কেনেন, তিনি আজ কিনেছেন সাড়ে সাতশো গ্রাম। যিনি পাঁচশো-ছ’শো গ্রাম কেনেন, তিনি কেনেননি।’’ আসলে গত কয়েক দিন নিলেও এ দিন আর পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেননি নূর। ‘‘কী করব? রাজাবাজারের এক পাইকারের কাছ থেকে মাল নিই। শনিবার পাঁচশো, হাজারের নোটে ৬০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। পুরোটাই উনি ফেরত দিয়েছেন। এর পরে তাই আমিও আর ওই নোট নিচ্ছি না,’’ বলছেন তিনি।

শুধু মাংস নয়। মাছ-মুরগি-সব্জি বাজারে রবিবারের ছবিটা ছিল এ রকমই। শনিবার বিকেল থেকেই পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়া বন্ধ করেছে পাইকারি বাজার। ফলে খুচরো বিক্রেতাদের একটা বড় অংশ রবিবার ক্রেতাদের কাছ থেকে পাঁচশো, হাজারের নোট নেননি। গড়িয়াহাট, লেক মার্কেট, মানিকতলা, দমদম, বাঘা যতীন বাজারে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, নোটের আকাল শুরুর পরে প্রথম রবিবার বিক্রিবাটা সব জায়গাতেই অন্তত ২০ শতাংশ পড়ে গিয়েছে। গত তিন দিন যাঁরা টাকা তুলতে পেরেছেন, এ দিন মূলত তাঁরাই বাজারে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ লাগাম টেনেছেন খরচে।

দু’দিন ব্যর্থ হওয়ার পরে শনিবার রাতে এটিএম থেকে দু’হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন ব্যারাকপুরের শ্যামল চক্রবর্তী। রবিবার সকালে তালপুকুর বাজার থেকে মাছ, সব্জি সবই কিনেছেন, তবে কম কম। শ্যামলবাবুর কথায়, ‘‘এই ধাক্কায় সব কিছুরই খরচ কমাতে হচ্ছে। টাকা বার করতে হচ্ছে বুঝেশুনে।’’

গড়িয়াহাট ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য শ্যামাকান্ত দে জানান, অন্য রবিবারের ১০ লক্ষ টাকার বেচাকেনার জায়গায় এ দিন গড়িয়াহাটের মাছবাজারে বিক্রি হয়েছে বড়জোর ছ’লক্ষ টাকার। অনেক ছোট ব্যবসায়ী বসতেই পারেননি। অথচ বাতাসে শীতের আমেজে স্বভাবতই মাছের জোগানে কমতি ছিল না। টাটকা ন্যাদোস, গুরজালি, ছোট পমফ্রেট, তোপসে, পার্শে, পাবদায় বাজার ছিল ভর্তি। কিন্তু কেনার লোক কম। দক্ষিণ কলকাতার এক খুচরো মাছ ব্যবসায়ী দানিশ মণ্ডলও বললেন, ‘‘অন্য রবিবার বেলা ১১টার মধ্যে ১৩-১৪ হাজার টাকার বিক্রি হয়, আর এ দিন মেরেকেটে পাঁচ হাজার টাকার বিক্রি হয়েছে।’’

আবার বহু ক্রেতা অল্প টাকার বাজার করে দু’হাজারের নোট ধরানোয় মুশকিলে পড়ছেন দোকানিরা। একশো-র নোট ছাড়া তাঁদের কাছে খুচরোর বিকল্প নেই। ‘‘তিন-চার জন খদ্দেরের প্রত্যেককে দু’হাজারের নোট ১০০ টাকায় খুচরো দিতেই তো ক্যাশবাক্স খালি হয়ে যাবে,’’ আক্ষেপ আজাদগড়ের ব্যবসায়ী দেবাশিস রায়ের। মানিকতলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহকারী সম্পাদক বাবলু দাসও বললেন, ‘‘রবিবার ছুটির দিনে সাধারণত থলেভর্তি বাজার করেন ক্রেতারা। আজ সেটা হয়নি।’’

মুরগি বিক্রেতা প্রদীপ নস্করের এক নিয়মিত খদ্দের এ দিন সকাল সওয়া সাতটায় তিন কেজি মুরগি কিনলেন ৩৯০ টাকায়। ওটাই প্রদীপবাবুর বউনি। কিন্তু ক্রেতার কাছে ৫০০ টাকার নোট। চেনা লোক বলে তাঁকে পরে টাকা মেটাতে বলেছিলেন প্রদীপবাবু। তবে বউনির সময়, ক্রেতাও তাই তখনকার মতো ১০ টাকার নোট ধরালেন। বাড়ি ফিরে এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলে বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ দাম মেটালেন ১০০ টাকার নোটে।

টাকার দেখা নাই। রবিবার, ভবানীপুরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

নোট পেতে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের লাইনে দাঁড়ানোও এই রবিবারের বাজার মার খাওয়ার অন্যতম কারণ। আজ, সোমবার ব্যাঙ্ক বন্ধ। গত তিন দিন যাঁরা টাকা তুলতে পারেননি, এ দিন টাকা পেতে যেন ধনুক ভাঙা পণ করেছিলেন। মনের মতো বাজার করার নগদ কম, তার উপরে কোনও রকমে ঘরে বাজার নামিয়ে ছুটতে হচ্ছে ব্যাঙ্ক বা এটিএমের লাইনে। পরিণাম, বিক্রিতে ভাটা।

কলকাতার বাজারে মাছের বড় অংশ আসে হাওড়ার আড়ত থেকে। সেখানে আর পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেওয়া হবে না বলে লিখিত ভাবে জানানো হয়েছে। দক্ষিণ শহরতলির বহু বাজারে মাছ যায় বাঘা যতীনের আড়ত থেকে। এ দিন তারাও বলে দিয়েছে, পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নেবে না। ফলে বাঁশদ্রোণী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী বাবু দাস এ দিন সব মিলিয়ে ৬০ কেজি মাছ তুলেছিলেন। অন্যান্য রবিবার তিনি তোলেন ৮০ কেজি।

সব্জির পাইকারি বাজার, কোলে মার্কেটের ব্যবসায়ী, চাষিরা শনিবার পর্যন্ত পাঁচশো, হাজারের নোট নিলেও রবিবার থেকে নারাজ। কাজেই রবিবারের সব্জি বাজারও ধাক্কা খেয়েছে। বিক্রেতা বুদ্ধদেব পাল বলেন, ‘‘অন্য রবিবারের তুলনায় বিক্রি অন্তত ২০ শতাংশ কম হয়েছে। রবিবার বেগুন, ঝিঙে, পটল সব ৩০ কেজি করে তুলি। আজ ২০ কেজির বেশি তুলিনি। তা-ও পড়ে আছে অনেকটা।’’

তবে এই পরিস্থিতিতেও বিক্রেতাদের একাংশ নিয়মিত খদ্দেরদের থেকে অচল নোটে দাম নিচ্ছেন। কেউ কেউ অচল নোট নিচ্ছেন বিক্রি বাড়াতে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘পরিবারের সবার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখানে টাকা জমা দেব। এই ফাঁকে ব্যবসাটা তো বাড়িয়ে নিই।’’

রানিকুঠি মোড়ের একটি মুদির দোকান এই সুবিধে দিচ্ছে। সকালে দমদম স্টেশন সংলগ্ন মাছ বাজারের কয়েক জন ব্যবসায়ী আবার হাঁক দিলেন, ‘‘কেন কষ্ট করে ব্যাঙ্কে যাবেন? পাঁচশো-হাজারের নোট আমাদের দিন, মাছ কিনুন।’’ মুহূর্তে উড়ে গেল ৬০০ টাকা কেজির গলদা ও চাপড়া চিংড়ি, তোপসে, ট্যাংরা, কাজরি। বাঘা যতীন বাজারে প্রচুর পরিমাণ মাছ কিনছিলেন এক ব্যক্তি। স্ত্রীর মৃদু ধমক, ‘‘এত মাছ কিনছ কেন?’’ স্বামী বললেন, ‘‘আরে এই ফাঁকে পাঁচশো, হাজারের নোটগুলো চালিয়ে নিই!’’ মানিকতলার মাছ ব্যবসায়ী সঞ্জয় বৈদ্যের কথায়, ‘‘বিক্রি না করে ফেলে তো রাখতে পারব না। তাই ৩০০ টাকার মাছ কিনলেই ৫০০ টাকার নোট ভাঙিয়ে দিচ্ছি।’’

নোটের আকালে ব্যবসা মার খাচ্ছে। বেহালা বাজারে কয়েক জন মাছ বিক্রেতা তাই আড়াইশো টাকা কেজিতে টাটকা কাটাপোনা বিক্রি করেছেন। অন্য রবিবারে যার দাম থাকে সাড়ে তিনশো-চারশো। ‘‘অনেকটা মাছ আগে তুলে রাখা ছিল। বিক্রি না হলে নষ্ট হবে। পুরোটাই লোকসান। আবার বরফ চাপা দেওয়ার খরচও কম নয়,’’ আফশোস বিক্রেতাদের গলায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cashless crowd Sunday Holiday Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE