Advertisement
E-Paper

যক্ষ্মা নির্ণয় নিয়েই বিভ্রাট, সঙ্কটে বালক

যক্ষ্মা, নাকি যক্ষ্মা নয়— একের পর এক চিকিৎসকের কাছে ঘুরেও এই রহস্যের সমাধান না হওয়ায় চিকিৎসা-বিভ্রাটে পড়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় বছর নয়ের এক বালক। একাধিক বেসরকারি ও সরকারি ক্ষেত্রের চিকিৎসকেরা তার যক্ষ্মা হয়েছে বলে জানিয়ে সরকার-গৃহীত ‘ডট্স’ প্রক্রিয়ায় ওষুধ চালু করে দেন।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৫৬
দুই প্রেসক্রিপশন বলছে যক্ষ্মা হয়েছে অভিজ্ঞানের। খেতে হবে ওষুধ।

দুই প্রেসক্রিপশন বলছে যক্ষ্মা হয়েছে অভিজ্ঞানের। খেতে হবে ওষুধ।

যক্ষ্মা, নাকি যক্ষ্মা নয়— একের পর এক চিকিৎসকের কাছে ঘুরেও এই রহস্যের সমাধান না হওয়ায় চিকিৎসা-বিভ্রাটে পড়ে সঙ্কটজনক অবস্থায় বছর নয়ের এক বালক।

একাধিক বেসরকারি ও সরকারি ক্ষেত্রের চিকিৎসকেরা তার যক্ষ্মা হয়েছে বলে জানিয়ে সরকার-গৃহীত ‘ডট্স’ প্রক্রিয়ায় ওষুধ চালু করে দেন। কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হয় না। আর এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, যক্ষ্মা হয়নি। তিনি লিখিত ভাবে যক্ষ্মার ওষুধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

তত দিনে এক মাস সেই ওষুধ খেয়ে ফেলেছে ৯ বছরের অভিজ্ঞান। যক্ষ্মার ওষুধ এক বার চালু হলে তা মাঝপথে বন্ধ করার ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। কারণ, তাতে শরীরে যক্ষ্মার প্রচলিত ওষুধের কার্যকারিতার উপরে প্রতিরোধ তৈরি হয়। এ দিকে, অভিজ্ঞানের শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। কাশি থামছে না, সে ভাল করে শ্বাস নিতে পারছে না, চোখেও ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। বিভ্রান্ত, দিশাহারা অভিভাবকেরা গোটা বিষয়টি জানিয়ে স্বাস্থ্য-অধিকর্তার কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। আজ ৩০ অক্টোবর ছেলেকে নিয়ে তাঁদের ভেলোরে চিকিৎসার জন্য রওনা হওয়ার কথা।

রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এবং যক্ষ্মা বিভাগের প্রধান শান্তনু হালদার এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের যক্ষ্মা বিভাগের একাধিক কর্তা এবং যক্ষ্মা নির্মূল আন্দোলনে জড়িত কর্মী-চিকিৎসকেরাই এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তাঁদের ব্যাখ্যায়, যক্ষ্মা প্রতিরোধ এবং ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জন্মেছে, এমন ‘ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ যক্ষ্মা আটকানোর সব চেয়ে বড় শর্ত হল, ঠিক ভাবে যক্ষ্মা চিহ্নিত করা ও ওষুধ খাওয়া। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কার্যক্রম রয়েছে। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ানদের এর জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন থুতু পরীক্ষার আধুনিক পন্থাও বেরিয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এর পরেও এই ধরনের বিভ্রান্তি হবে কেন?’’

বলছে যক্ষ্মা হয়নি। ওষুধ বন্ধ করতে হবে।—নিজস্ব চিত্র।

প্রসঙ্গত, ভারতে যক্ষ্মা পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও উদ্বিগ্ন। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২২ লক্ষ। বিশ্বের প্রতি চার জন যক্ষ্মা রোগীর মধ্যে এক জন হলেন ভারতীয়। যক্ষ্মা চিহ্নিত হওয়ার পরে চিকিৎসার মাঝপথে হারিয়ে গিয়েছেন বা অর্ধেক চিকিৎসা পেয়েছেন, এমন রোগীর সংখ্যা ভারতে সাড়ে সাত লক্ষের বেশি। এঁদেরই ‘ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ’ যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা। এবং এঁরা সুস্থ মানুষের মধ্যে সরাসরি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি-ই ছড়াতে পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যার রিপোর্ট এ-ও বলছে যে, ভারতে আনুমানিক যে পাঁচ লক্ষ যক্ষ্মা রোগী সরকারি যক্ষ্মা ক্লিনিকের শরণাপন্ন হন, তাঁদের অনেকেরই রোগ ঠিকঠাক চিহ্নিত হয় না। অনেকের আবার রোগ চিহ্নিত হয়ে ডটস-এর আওতায় ওষুধ চালু হলেও চিকিৎসার মাঝপথে আর রোগীর ফলো-আপ হয় না। এঁদেরও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অভিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমনই হতে চলেছে কি না, তা নিয়েও চিকিৎসকদের একাংশ আতঙ্কিত।

হুগলির চুঁচুড়ার নারকেলবাগান এলাকার বাসিন্দা অভিজ্ঞানকিশোর দাস ক্লাস ফোরের ছাত্র। আর পাঁচটা ন’বছরের ছেলের মতোই ছটফটে, হুল্লোড়ে। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে তার হঠাৎই শুকনো কাশি শুরু হয়, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। দক্ষিণ কলকাতার এক নামী বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তারা সব রকম পরীক্ষা করে ২৬ সেপ্টেম্বর লিখিত ভাবে জানান, অভিজ্ঞানের যক্ষ্মা হয়েছে। ওষুধ চালু করতে হবে। অভিজ্ঞানের বাবা অনিন্দ্যকিশোর দাস জানিয়েছেন, ওই দিনই তিনি ছেলেকে হাওড়া জেলা যক্ষ্মা কেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখানেও মান্টু টেস্ট ও অন্যান্য পরীক্ষার পরে চিকিৎসক জানান, যক্ষ্মাই হয়েছে অভিজ্ঞানের। এবং তিনি ডটস-এর আওতায় যক্ষ্মার ক্যাট-১ চিকিৎসা চালু করতে বলেন লিখিত ভাবে। অভিজ্ঞানকে ওষুধ নেওয়ার জন্য রেফার করা হয় হুগলি ইমামবড়া সরকারি হাসপাতালে।

ইমামবড়া হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও যক্ষ্মা হয়েছে বলে জানান এবং ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে অভিজ্ঞানের ডটস-এর আওতায় যক্ষ্মার ওষুধ চালু হয়। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির বদলে অবনতি হতে থাকে। টানা মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়, সেই সঙ্গে ঘাড় ফুলে ওঠে। উপায়ান্তর না দেখে বাড়ির লোক তাকে তখন নীলরতন মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা লিখিত ভাবে জানান যক্ষ্মার সঙ্গে মেনিনজাইটিস হয়েছে অভিজ্ঞানের। তাকে নিউরোসার্জারিতে নিউরো ইনটেনসিভ ট্রিটমেন্ট ইউনিট-এ ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানেও অবস্থার উন্নতি হয় না। বাড়ির লোকের বক্তব্য, ‘‘১০ দিন সেখানে ভর্তি থেকেও যখন কোনও উন্নতি হয় না, তখন নীলরতনের ডাক্তারবাবুরা জানান, ‘সাসপেক্টিভ টিবি’। অর্থাৎ টিবি হতেও পারে, না-ও পারে। তবে তাঁদের ধারণা, অভিজ্ঞানের মাইগ্রেন হয়েছে।’’

দিশাহারা বাবা-মা এর পরে তাকে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের বক্ষ বিভাগের প্রধান প্রণব মণ্ডলের কাছে নিয়ে যান। তিনি পরীক্ষা করে লিখিত ভাবে জানান, মোটেই যক্ষ্মা হয়নি। এবং লিখিত ভাবে যক্ষ্মার ওষুধ বন্ধ করে দিতে বলেন। তা হলে অন্য সরকারি হাসপাতাল ও যক্ষ্মা কেন্দ্র সেটা বুঝতে পারল না কেন? কেন যক্ষ্মা হয়েছে জানিয়ে ডটস-এর চিকিৎসা শুরু করলেন? এর উত্তরে প্রণববাবু বলেন, ‘‘এটা বিতর্কিত বিষয়। আপনাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করব না।’’

অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ভেলোর ছোটার আগে স্বাস্থ্য দফতরের প্রতি অভিজ্ঞানের বাবা-মা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘তা হলে কি সামান্য যক্ষ্মা চিহ্নিত করার জন্যও এ বার দক্ষিণ ভারত দৌড়তে হবে? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামোর কি শেষে এমনই অবস্থা হল?’’

NRS Hospital Patient Tuberculosis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy