চলছে উদ্ধারকার্য- ছবিঃ স্বাতী চক্রবর্তী
ট্রামলাইনের উপর এখনও ভাঙা ফ্লাইওভারটার যে দৈত্যের সাইজের অংশটা পড়ে আছে, তার নীচে আর কতগুলো অসহায় মানুষের মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে জানি না। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বিশাল একটা লরি কেমন খেলনা গাড়ির মত চেপ্টে পড়ে আছে। লরিটার ড্রাইভার, খালাসিদের কথা ভাবতেই গা শিউড়ে উঠেছে। এখনও সেনা জওয়ানরা পুরোদমে উদ্ধারকার্য চালাচ্ছেন। হাইড্রোলিক জ্যাক, ক্রেন দিয়ে ধীরে ধীরে সরছে চাঙড়। লোহার পাত গুলোকে ছোট ছোট টুকরোয় কেটে ফেলছে যন্ত্র। সেই যান্ত্রিক শব্দ যত তীব্র হচ্ছে তত বাড়ছে আতঙ্ক। এই ধ্বংসস্তূপ যে দিন পুরো সাফ হবে, জানা নেই সেই সাফাইয়ের পথে উঠে আসবে আরও কত ক্ষত, বিক্ষত, রক্তাক্ত, পিষে যাওয়া প্রাণহীন দেহ। সরকার মৃতদেরকে যে সংখ্যায় বাঁধছে তা মানতে পারছি না। গতকাল, দুর্ঘটনার সময় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলাম। আজ ভোর ৫টা থেকে আবার চলে গিয়েছি। নিজের চোখের সামনেই ছটফট করে, যন্ত্রণায় কাতরাতে, কাতরাতে অনেককে মবে যেতে দেখেছি। হ্যাঁ, বাস্তবে মৃতের সংখ্যাটা সরকার ঘোষিত সংখ্যার থেকে আরও অনেকটাই বেশি।
আমি বহুদিনই পোস্তা অঞ্চলের বাসিন্দা। এলাকার লোক হওয়ার সুবাদে ফ্লাইওভার তৈরির দায়িত্ব থাকা, বেশ কয়েক জন ইঞ্জিনিয়র, শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল। গতকাল, দুর্ঘটনার মিনিট পাঁচেক আগেই, ওখানকার এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখন ওখানে পুরোদমে চলছে ঝালাইয়ের কাজ। তার আগের দিন রাতেই উড়ালপুলের উপর চড়ানো হয়েছে সিমেন্টের পরত। অবাক হলাম, অত ঘিঞ্জি অঞ্চল, যেখানে একটা উড়ালপুরে পুরোদমে কাজ চলছে, সেখানে নীচে দিয়ে কী করে বেমালুম চলছে যানবাহন? কথায়, কথায় ইঞ্জিনিয়র ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ব্যারিকেড নেই কেন?’’ কোনও সদুত্তর পেলাম না। বদলে পেলাম, কতগুলো গোল গোল খাপছাড়া কথা। কিছু না বুঝেই রওনা দিয়েছিলাম বাড়ির দিকে। আর তারপরেই সেই ভয়ানক শব্দ, ছুট্টে উড়ালপুরের দিকে রওনা দিলাম। গিয়ে দেখলাম আমার সেই হঠাত্ আশঙ্কাকে সত্যি করে দুঃস্বপ্নের মত ভেঙে পড়েছে ফ্লাইওভারটার একাংশ। মাথা কাজ করছিল না। মনে হচ্ছিল, এই তো এখনই কতজন হেঁটে পার হচ্ছিলেন ওখান থেকে, এই তো কতগুলো গাড়ি চলাচল করছিল, কী হল তাদের, কী হল মানুষ গুলোর... ভাবতে ভাবতে আরও অনেকের সঙ্গে ছুটে গেলাম, যদি বাঁচাতে পারি কাউকে...
আরও পড়ুন-উড়ালপুলকে ভেঙে পড়তে দেওয়া হল ঠিক কী কারণে, সরকার বাহাদুর?
এত বড় একটা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে আসতে পুলিশ, দমকলের দু’ঘণ্টা লেগে গেল? এলাকার মানুষগুলোই তো অনেক আগে নিজেদের সীমিত সব সামর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর, পুলিশের যখন এই পরিস্থিতি সামলাবের ক্ষমতাই নেই, তা হলে সেনা জওয়ানদের ডাকতে এত সময় লাগল কেন? কে দেবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর? কেন দেরি করে এসেও পুলিশ ব্যস্ত থাকে জওয়ানদের উপর খবরদারি করায়? চোখের সামনে চাপা পড়া একটা জ্যান্ত মানুষকে যখন একটু জলের জন্য ছটফট করতে দেখি, যখন তার মুখে একটু জল দেওয়ার পরেও সাহায্যের আবেদন করতে করতে লোকটার দেহটা নিস্তেজ হয়ে যেতে, তখন ওই দানবিক স্ল্যাব সরিয়ে তাকে উদ্ধার করতে না পারার আমাদের অক্ষমতা কুরেকুরে খায়। এই ম়ৃত্যুর দায় কে নেবে? কীসের বিনিময়ে এতগুলো প্রাণের মূল্য চোকানো যাবে? সাহায্যের নামে পুলিশের এই প্রশাসনিক প্রহসনটা বন্ধ হোক। বন্ধ হোক এই রাজনৈতিক আকচা আকচি। এ বার অন্তত, একবারের জন্য স্বীকার করে নিন নিজেদের চূড়ান্ত অপদার্থতা। অনেকগুলো মানুষ মরলো যে...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy