Advertisement
E-Paper

ব্যঙ্গের খোঁচা ঠেলে দিচ্ছে মন খারাপে

খালি পায়ে, রংচটা শাল গায়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে শিয়ালদহের আর আহমেদ ডেন্টাল হাসপাতালের আউটডোরে পৌঁছেছিল আসমত আরা ও তার মা শুভানুর বিবি। চিকিৎসকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শুভানুর— ‘‘যে করে হোক, আমার মেয়েটার দাঁত ঠিক করে দাও ডাক্তারবাবু।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:০৮

খালি পায়ে, রংচটা শাল গায়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে শিয়ালদহের আর আহমেদ ডেন্টাল হাসপাতালের আউটডোরে পৌঁছেছিল আসমত আরা ও তার মা শুভানুর বিবি। চিকিৎসকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন শুভানুর— ‘‘যে করে হোক, আমার মেয়েটার দাঁত ঠিক করে দাও ডাক্তারবাবু। আমরা দিনমজুরি করি। মেয়েটার লেখাপড়ায় মাথা ভাল। সেই মেয়ে আর ইস্কুল যেতে পারছে না গো!’’

উপরের পাটির দাঁত উঁচু হয়ে ঠোঁটের বাইরে। সহপাঠীরা বিদ্রূপ করে। পঞ্চম শ্রেণির মেয়ে বলছিল, ‘‘ক্লাসে ঢুকে থেকে ওরা বলতে শুরু করে, ‘তোর দাঁত তো নয়, যেন মাটি কাটার মেশিন! তুই মাঠে গিয়ে দাঁত দিয়ে মাটি তোল।’ বলে, ‘ওই যে রাক্ষসী এসেছে।’ ওরা হাসে, খোঁচায়। খুব কষ্ট হয়। পালিয়ে আসি।’’ ৩০ ডিসেম্বরের ওই সকালের আগে তিন মাস স্কুলে যায়নি আসমত।

প্রত্যন্ত গ্রামের অখ্যাত স্কুলের দরিদ্র ছাত্রী আসমত আরা-র একেবারে বিপরীত আর্থ সামাজিক অবস্থানে সল্টলেকের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শ্রাবস্তী গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু চেহারা নিয়ে প্রায় একই রকম অবসাদ। ওজন বাড়তে থাকায় বিশেষত স্কুলে সহপাঠীদের নানা মন্তব্যে বিধ্বস্ত হয়ে কোনও খাবার খেলেই মোটা হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলত রাজারহাটের নামী ইংরেজিমাধ্যম কো-এড স্কুলের সেই মেয়ে। চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম ‘অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা’। অপুষ্টির জেরে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হয় তাকে।

চেহারা নিয়ে উত্ত্যক্ত করা বা তাতে মুষড়ে পড়ে অবসাদ—দুটোই যে অনভিপ্রেত ও অযৌক্তিক, ছাত্রছাত্রীদের অনুভবে তা গেঁথে দিতে শ্রাবস্তীকেই মাধ্যম করেছিল স্কুল। অ্যাসেম্বলিতে শ্রাবস্তীকে দিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলিয়ে বাকিদের সচেতন করা হতো। কিন্তু শিক্ষাবিদ ও মনোবিদদের প্রশ্ন, রাজ্যের কত স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এত গভীরে গিয়ে ভাবনায় উদ্যোগী? সেই পরিকাঠামোই বা কত স্কুলে রয়েছে?

বাসন্তী বিশ্বাস বা সীমা সাপ্রু-র মতো অধ্যক্ষারা জানান, তাঁদের স্কুলে গ্রুপ কাউন্সেলিং ও একান্ত কাউন্সেলিংয়ে পড়ুয়াদের অবসাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। সান্ত্বনা সেনশর্মা বা দেশবন্ধু সইয়ের মতো প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা জানান, আগে জীবনশৈলী পাঠের ক্লাসে এ সব বিষয় কিছুটা দেখা হতো, এখন বন্ধ। স্কুলে আলাদা কাউন্সেলার নেই। তাঁদের প্রশ্ন, শিক্ষক-শিক্ষিকারাই বা কত দিকে নজর দেবেন?

শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, খাস কলকাতার বহু নামী সরকারি-বেসরকারি স্কুলের বহু শিক্ষক-শিক্ষিকারও এই ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর মতো মানসিক ব্যাপ্তি নেই। তাঁরা যে পরিকাঠামো বা পরিবেশে বড় হয়েছেন, সেখানে হয়তো চেহারা নিয়ে কথা বলাটাই দেখেছেন। ফলে এখন ছাত্রছাত্রীর চেহারা নিয়ে অনেক সময়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে ফেলেন। ভাবেন না, তা কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আর আহমেদ হাসপাতালে আসমতের চিকিৎসক পার্থপ্রতিম চৌধুরী জানান, দক্ষিণ কলকাতার নামী স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রকে তার উঁচু দাঁতের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসটিচারও ‘ঈশান অবস্তি’ (‘তারে জমিন পর’ ছবির শিশু অভিনেতা, যার দাঁত উঁচু ছিল) বলে ডাকতেন! মানসিক আঘাতে ছেলেটি স্কুলে যেতে চাইত না। মনোবিদদের ভাযায়, ‘বডি ডিসমরফোবিয়া’ বা ‘বডি ডিসমরফিক ডিজর্ডার’ নামে এই রোগে সমস্ত অঙ্গকে কুৎসিত মনে করে রোগী।

সর্বশিক্ষা মিশন (কলকাতা)-এর চেয়ারম্যান কার্তিক মান্না মানছেন, ‘‘এখনও অধিকাংশ স্কুলে চেহারার জন্য কাউকে নিয়মিত অন্য ছাত্রছাত্রীরা খেপাচ্ছে শুনলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা মৌখিক ‘এ রকম কোরো না’ বা ‘বলবে না’-র মতো দায়সারা সতর্কবার্তা দেন। নতুন কোনও পন্থার বিষয়ে ভাবেন না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এটা র‌্যাগিংয়ের চেয়ে কিছু কম নয়, অথচ সে ভাবে চিহ্নিত হয় না।’’

চেহারা নিয়ে যাতে পড়ুয়াদের হীনম্মন্যতা না জন্মায়, তার জন্য যথাসম্ভব সতর্ক থাকা হয় বলে দাবি করেন শিক্ষা দফতরের সিলেবাস কমিটির দায়িত্বে থাকা অভীক মজুমদার। তিনি জানান, সম্প্রতি ফুটবল নিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা একটি গল্প শেষ মুহূর্তে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ যায়। কারণ তাতে নায়কের চেহারা নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। তবে তিনি মানেন, এই সতর্কতাই যথেষ্ট নয়।

তা হলে কী করতে হবে? শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, ‘‘ছোট থেকে বোঝাতে হবে, তুমি তোমার মতো। শরীর ও মন সুস্থ রাখাটাই আসল কথা।’’ শিক্ষাবিদ ও মনোবিদেরা বলছেন, বোঝাতে হবে চেহারায় মানুষের হাত নেই কিন্তু ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও কেরিয়ার গড়া তার হাতে। তা করতে পারলে সকলের ভালবাসা, মর্যাদা ও আদর মেলে। পাশাপাশি, ছোট থেকে ভাল কাজে প্রশংসা করাটাও জরুরি। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। উঁচু দাঁত নিয়েও রোনাল্ডিনহোর দাপট, বেঁটে হয়েও সচিন তেন্ডুলকরের জাদু, কালো হয়েও কাজল-বিপাশাদের সাফল্যের মতো উদাহরণ ছোটদের মনে গেঁথে দিলে হাতেনাতে ফল মিলবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

emotional abuse teasing teenagers parijat bandopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy