Advertisement
E-Paper

শিশুকে নিয়ে যেতেই বৃহন্নলার কান্না

শিশু চুরির তদন্তে নেমে ওঁরা শুধু এটুকু জানতে পেরেছিলেন, চলন্ত ট্রেনে রায়পুরের একদল হিজড়ে কেড়ে নিয়েছেন বাচ্চাটিকে। অতঃপর... ওঁদের ভিন্ রাজ্যে অভিযান এবং ‘অপারেশন সাকসেসফুল’! শিশুটিকে উদ্ধার করে হাওড়ামুখী ট্রেন ধরলেন বৌবাজার থানার বিশেষ তদন্তকারী দলের অফিসার ও কনস্টেবলরা। লাইন দু’টো পড়ে রায়পুরের অলিগলিতে দুর্দান্ত পুলিশি অভিযানের একটা চিত্রনাট্য মনে মনে খাড়া করে নেওয়াই যায়।

শিবাজী দে সরকার ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৮

শিশু চুরির তদন্তে নেমে ওঁরা শুধু এটুকু জানতে পেরেছিলেন, চলন্ত ট্রেনে রায়পুরের একদল হিজড়ে কেড়ে নিয়েছেন বাচ্চাটিকে।

অতঃপর...

ওঁদের ভিন্ রাজ্যে অভিযান এবং ‘অপারেশন সাকসেসফুল’! শিশুটিকে উদ্ধার করে হাওড়ামুখী ট্রেন ধরলেন বৌবাজার থানার বিশেষ তদন্তকারী দলের অফিসার ও কনস্টেবলরা।

লাইন দু’টো পড়ে রায়পুরের অলিগলিতে দুর্দান্ত পুলিশি অভিযানের একটা চিত্রনাট্য মনে মনে খাড়া করে নেওয়াই যায়। কিন্তু সেই মানস-অঙ্ক মিলবে কি না, এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। লালবাজারের দুঁদে অফিসারেরাই অঙ্কটা মেলাতে পারছেন না। পারছেন না, যখন থেকে তাঁরা জেনেছেন, সন্দেহভাজন ‘অপহরণকারী’র হাত থেকে শিশুটিকে বাঁচাতেই তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ওই হিজড়ে তথা বৃহন্নলারা। এবং স্থানীয় পুলিশকে সব কিছু জানিয়েই প্রায় এক পক্ষকাল ধরে শিশুটিকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন তাঁরা। সেই একরত্তি মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়েই ওঁদের চোখের জল বাঁধ ভাঙল। অথচ সত্যিকারের ‘মা’ ডাক তো ওঁদের শোনা হবে না কোনও দিনই।

খুব স্বাভাবিক, রায়পুরে হিজড়েদের সেই মহল্লা ছেড়ে আসার সময়ে বৌবাজার থানার বিশেষ তদন্তকারী দলের সদস্যেরা টের পেয়েছিলেন, তোলপাড় চলছে তাঁদের ‘পুলিশি’ মনের ভেতরেও। পরে এক অফিসার অস্ফুট বিস্ময়ে বলছিলেন, “মাঝেমধ্যে এই মানুষগুলোর নামেই দূরপাল্লার ট্রেনে দৌরাত্ম্যের অভিযোগ ওঠে!”

শুধু কি তা-ই? বাচ্চা হওয়া মানেই আশা-আশঙ্কার অদ্ভুত মিশেলে ভোগে বাঙালি গৃহস্থ। এক দিকে বাচ্চা ‘নাচাতে’ এসে মোটা টাকা চেয়ে হিজড়েদের জুলুমের ভয়। আবার ‘ওই সময়টায়’ হিজড়েরা দেখা না দিলেও কেউ কেউ ভুগতে থাকেন শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে নানা আশঙ্কায়। এক দিকে চলন্ত ট্রেনে বিকট হাততালির শব্দ শুনে ঘুমের ভান করেন কিছু প্যাসেঞ্জার। আবার ‘ওঁরা’ মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদটা না করলে খুঁতখুঁতুনি রয়ে যায় অনেকেরই!

কলকাতা পুলিশের অফিসারটি অবশ্য বলছেন, “রায়পুরে অন্য ছবি দেখলাম!” গল্পটা খুলেই বলা যাক।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে মেডিক্যাল কলেজের ফুটপাথ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল বছর দুয়েকের একটি বাচ্চা মেয়ে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, মুজফ্ফর খান নামে এক যুবক মাঝেমধ্যেই শিশুটিকে কোলে নিয়ে এ দিক-ও দিক বেড়াতে যেত। ক’দিন হল সে-ও উধাও। শেষ পর্যন্ত পার্ক সার্কাস স্টেশনে মুজফ্ফরের খোঁজ মিললেও শিশুটির চিহ্ন মেলেনি। তবে মুজফ্ফর নাকি স্বীকার করে, বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের দূরপাল্লার ট্রেনে ট্রেনে সে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছিল। এই সময়েই ছত্তীসগঢ়ের রায়পুরের একদল হিজড়ে তার কাছ থেকে বাচ্চাটিকে কেড়ে নিয়েছে বলে সে পুলিশকে জানায়।

‘শিশু চুরির চক্রে’র মোকাবিলায় দ্রুত ছকে ফেলা হয় ‘মিশন রায়পুর’। বৌবাজার থানার ‘ছোটবাবু’ অমিত ঠাকুরের নেতৃত্বে বিশেষ দল গড়েন ওসি শান্তনু চট্টোপাধ্যায়। ইতি হালদার ও পম্পা ভট্টাচার্য নামে দুই মহিলা কনস্টেবলকেও দলে রাখা হয়। শিশুটির মা-বাবাকেও সঙ্গে নেয় পুলিশ। রায়পুরে পৌঁছে স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই তাজ্জব বনে যান অফিসারেরা। তাঁরা জানতে পারেন, কয়েক জন হিজড়ে ইতিমধ্যেই নিজেদের সঙ্গে রাখা একটি শিশুর কথা পুলিশকে জানিয়েছেন। একটি লোক শিশুটিকে অপহরণ করেছে বুঝতে পেরে তাঁরা বাচ্চাটিকে কেড়ে নিয়েছিলেন। অফিসারেরা আঁচ করেন, সেই ‘লোক’ই কলকাতার মুজফ্ফর। জানা যায়, গত দিন পনেরো ধরে রায়পুরে হিজড়েদের বস্তিতেই রয়েছে শিশুকন্যাটি।

অবাক হলেও কলকাতার অফিসারেরা তখনও কিছুটা সাবধানী। হিজড়েদের ডেরাটি চিহ্নিত করার পরেও তাঁরা আশঙ্কায় ছিলেন, হয়তো শিশুটিকে উদ্ধার করতে গেলে প্রবল বাধা আসবে! তাই পদে-পদে স্থানীয় পুলিশের সহায়তা নিয়েই এগোচ্ছিলেন। অবশেষে শুক্রবার তাঁরা পৌঁছে যান হিজড়েদের বস্তিতে। বৌবাজারের সাব-ইনস্পেক্টর মানিক দে দেখেন, একটি ঘরের সামনে বসে আপনমনে খলখল হেসে খেলছে শিশুটি। মানিকবাবু এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলতেই সে কেঁদে ওঠে।

সঙ্গে-সঙ্গে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে মানিকবাবুকে ঘিরে ফেলেন এক দল হিজড়ে। কে আপনারা? কোথাকার পুলিশ? পরিচয়পত্র কই? শিশুটির মা-বাবা কোথায়? এত প্রশ্ন শুনতে হবে ভাবেননি অফিসারেরা। অনেক কষ্টে খুকির ‘পালিকা মায়েদের’ সত্যিটা বোঝাতে পারেন তাঁরা।

আর ঠিক তখনই আবহাওয়া ভারী হয়ে আসে! রক্তের সম্পর্কহীন খুকির জন্য অঝোরে কাঁদতে থাকেন হিজড়ে-মায়েরা। স্নেহের প্রবল ঢেউয়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে যায় উর্দিধারীর ‘কর্তব্য’।

‘পালিকা মায়েদের’ ধন্যবাদ জানিয়ে শিশুটিকে নিয়ে মহল্লা ছাড়ে পুলিশ। পরের দিন, শনিবার রায়পুরের আদালতে মেয়েকে চিহ্নিত করেন মা-বাবা। রবিবার রায়পুর থেকে মা-বাবা-মেয়েকে নিয়ে হাওড়ার ট্রেন ধরে পুলিশের দল।

child abduction raipur eunach kuntak chattopadhyay shibaji dey sarkar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy