বছর দুই আগে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তখন পড়তাম ক্লাস টু-তে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারলে হয়তো ক্লাস ফোর পাশ করে যেতাম। কিন্তু পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে গেল। আপাতত ১২০০ টাকা মাস মাইনের কাজ করি জুতোর কারখানায়।
স্কুলে ভর্তির বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পরেই মা-বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন তপসিয়ার গোলাম জিলানি খান রোডের পুরসভার স্কুলে। তখন বয়স আটের আশপাশে। ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রয়েছে ওই স্কুলে। পাড়ায় আমার বয়সি কেউ কেউ বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হলেও বাবা-মা পুরসভার স্কুলেই ভর্তি করেন। বাবা বলেছিলেন, বাড়ির পাশেই স্কুল। সুবিধা হবে। আমরা চার ভাইবোন। আমাদের পরিবারের সামর্থ্যও ছিল না বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর।
বাড়ি থেকে দু’-তিন মিনিটের দূরত্বে পুরসভার ওই স্কুলে ছাত্রছাত্রী বলতে সব মিলিয়ে একশো জন মতো। ছোট ছোট ঘরে ক্লাস হয়। কোনও ঘরে ফ্যান আছে, কোনও ঘরে নেই। বৃষ্টি হলে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে ক্লাসঘর ভেসে যায়। আর পড়াশোনা? অর্ধেক দিনই সব ক্লাস ঠিকমতো হত না। স্কুল থেকে যে যার মতো বেরিয়েও পড়ত ইচ্ছেমতো!
এ ভাবে এক বছর চলল। ওয়ান থেকে টু-তে উঠলাম। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়াও শুরু হল। কিন্তু স্কুলে পড়াশোনা ঠিক মতো না হওয়ায় মা-বাবা উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। এর মধ্যেই আবার লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় স্কুলে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ওই শেষ। অভাবের সংসারে পড়াশোনা বলতে ওই ক্লাস টু পর্যন্তই। তা-ও পাশ করা হয়নি।
লকডাউনে মিড-ডে মিলের জিনিসপত্র আনতে মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতাম ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে আর সম্পর্ক ছিল না। কিছু দিন বাদে বাবা কথা বলে এলাকারই একটি মোটরবাইকের দোকানে কাজ শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। মাস ছয়েক সেখানেই কাজ শিখলাম। হাতখরচের টাকা পেতাম কিছু। কিন্তু কয়েক দিন পরে সেই কাজও বন্ধ হয়ে গেল।
আমার বাবা কাজ করতেন জুতো তৈরির কারখানায়। অভাবের সংসার। এক কথায় নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। তার উপরে ভাইবোনেরা সকলেই স্কুলে পড়ে। তবে আমার থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে কাউকে আর পুরসভার ওই স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। একটু দূরের একটি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে ওদের। আর আমি বছরখানেক ধরে তপসিয়ার ধাপা পাড়ার বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে একটি জুতো তৈরির কারখানায় কাজ করছি। রোজ সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা। দুপুরে ৩০ মিনিটের জন্য টিফিন করার ‘ছাড়’। সেই সুযোগেই বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে আবার কারখানায় চলে যাই।
কারখানা থেকে মাসে ১২০০ টাকা দেয়। পুরোটাই বাড়িতে দিয়ে দিই। আমি কিন্তু এখনও পড়তে চাই।
স্কুলছুট শ্রমিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy