তাঁর দাবি, তিনি শিক্ষায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ রুখতে গিয়েছিলেন। পারেননি। উল্টে নিজেই রাজনীতির শিকার হয়ে গিয়েছেন বলে আক্ষেপ করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী।
এক বছর আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে উথালপাথাল হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তার জেরে শিক্ষাঙ্গনে বেনজির পুলিশি আক্রমণেরও সাক্ষী হয়েছে রাজ্য। যাদবপুরে দানা বাঁধা সেই ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের আঁচে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হয়। পরিণতিতে এ বছরের গোড়ায় সরে যেতে হয় তদানীন্তন উপাচার্য অভিজিৎবাবুকে। যৌন নির্যাতনের অভিযোগটি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির (আইসিসি)-র রিপোর্ট মঙ্গলবার আনন্দবাজারে প্রকাশিত হওয়ার পরে অভিজিৎবাবুর আক্ষেপ, তাঁর বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের ক্ষোভ যে কতটা ভিত্তিহীন ছিল, তা তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, আইসিসি’র রিপোর্ট মোতাবেক, ছাত্রীটির উপরে যৌন নির্যাতনের কোনও প্রমাণ মেলেনি। ঘটনাটিকে ‘যৌন হেনস্থা’র পর্যায়ে ফেলে কমিটি জানিয়েছে, মেয়েটির লিখিত অভিযোগ ও মৌখিক বয়ানেও বিস্তর অসঙ্গতি রয়েছে। রিপোর্টটি গত নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়লেও এখনও এগজিকিউটিভ কাউন্সিল (ইসি)-এ পেশ হয়নি। ফলে তা সরকারি ভাবে অপ্রকাশিতই রয়ে গিয়েছে। যদিও রিপোর্টের বক্তব্য প্রকাশ্যে আসায় পুরো বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। আন্দোলনের ‘উৎস’ নিয়ে বিভ্রান্তি জেগেছে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের মধ্যে।
এবং এ হেন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ দিন অভিজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি চাই সমস্ত সত্যি ঘটনা প্রকাশ্যে আসুক। সকলেই জানুক।’’ অপসারিত উপাচার্যের বক্তব্য: তাঁর বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের অভিযোগ ছিল, তিনি ঘটনার যথাযথ তদন্ত করাচ্ছেন না। ‘‘ওদের বোঝাতে পারিনি, ধারণাটা কত অসার।’’— খেদ অভিজিৎবাবুর। বর্তমানে শিবপুর আইআইইএসটি-র ওই শিক্ষকের দাবি, ‘যৌন নির্যাতন, ছাত্র আন্দোলন, পুলিশি হস্তক্ষেপ— সব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য একটা স্বাধীন কমিটি গড়ার চেষ্টা করেছিলাম। তাতে কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে রাখার ইচ্ছেও ছিল। শেষ পর্যন্ত পারলাম না। আমার ইচ্ছেটা ছাত্র-ছাত্রীদের জানাতেও পারলাম না। তার আগেই রাজনীতির শিকার হয়ে গেলাম!’
কিন্তু রাজনৈতিক আনুগত্যের জন্য তো ওঁরই দিকে আগে আঙুল উঠেছে! শাসকদলের সংগঠনের নানা অনুষ্ঠানমঞ্চে তাঁকে দেখা গিয়েছে। এমনকী, ওঁকে যাদবপুরের স্থায়ী উপাচার্য করার ক্ষেত্রেও দলীয় আনুগত্যের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ। উপরন্তু শিক্ষকমহলের একাংশের ধারণা, পূর্বসূরি শৌভিক ভট্টাচার্যকে সরানোয় তিনিও পিছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন।
অভিজিৎবাবু অবশ্য ওই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, ‘প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিমুক্ত রাখার তাগিদেই আমি কোনও রাজনৈতিক নেতার সংশ্রবে আসিনি।’’ বস্তুত এই কারণেই কেউ প্রকাশ্যে ওঁর পাশে এসে দাঁড়াননি বলে জানিয়েছেন তিনি। অভিজিৎবাবুর কথায়, ‘‘দেখলাম, লড়াইয়ে আমি একা। সমস্ত দায় কাঁধে নিয়ে আমাকেই সরে যেতে হল।’’ আর শৌভিকবাবু প্রসঙ্গে অভিজিৎবাবুর মন্তব্য, ‘‘ওঁর সঙ্গে আমার এখনও বন্ধুর সম্পর্ক।’’
কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বরের সেই রাতে ক্যাম্পাসে তো তিনিই পুলিশ ডেকেছিলেন! সেটা কেন?
অভিজিৎবাবুর দাবি, সিদ্ধান্তটা ওঁর একার ছিল না। ‘‘ইসি সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করেই ঘেরাও তুলতে পুলিশ ডেকেছিলাম। পুলিশ কী ভাবে কাজ করবে, সেটা তো আমরা ঠিক করে দিতে পারি না!’’— ব্যাখ্যা তাঁর। প্রাক্তন উপাচার্যের মন্তব্য, ‘‘সে রাতে যা ঘটেছে, দুর্ভাগ্যজনক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে রাজনীতি ও পুলিশ না ঢোকাই ভাল।’’ ওই রাতে ইসি বৈঠকে হাজির থাকা এক সদস্যও বলেন, ‘‘অভিজিৎবাবু পুলিশ ডাকার প্রস্তাব দিলে কেউ কিন্তু তখন আপত্তি করেননি!’’
ঘটনাক্রম বলছে, ২০১৫-র ১৪ জানুয়ারি অভিজিৎবাবুর পদত্যাগের পরে হোক কলরবের ‘সাফল্য’ মিছিল বেরিয়েছিল। যৌন নির্যাতনের তদন্ত প্রসঙ্গও ক্রমশ আড়ালে চলে যায়। আন্দোলনের নেতাদের এখন কী বক্তব্য?
হোক কলরবের পরিচিত মুখ গীতশ্রী রায় এ দিন বলেন, ‘‘শ্লীলতাহানির তদন্তের দাবিতে আমাদের অবস্থান শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ ঢুকিয়ে মার খাওয়ানোর প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি ওঠে।’’ অভিজিৎবাবুর ইস্তফার পরে তদন্ত-রিপোর্ট প্রকাশের দাবিতে যে ভাবে ভাটা পড়ল, তাতে অন্য বার্তা যাচ্ছে না কি? গীতশ্রীর উত্তর, ‘‘আইসিসি’তে ছাত্র প্রতিনিধি রাখার দাবি আমাদের এখনও আছে।’’ ফেটসু’র চেয়ারম্যান শুভব্রত দত্তও বলেন, ‘‘আইসিসি-তে ছাত্র প্রতিনিধি রেখে তদন্ত করানোর দাবি গোড়া থেকেই ছিল। অভিজিৎবাবু করাননি। পরে পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়েছে। তাই আমরা আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলাম।’’
পাশাপাশি ছাত্র প্রতিনিধিহীন কমিটির তদন্ত-রিপোর্টের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শুভব্রত। ওঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন যে সব শিক্ষাবিদ, অভিজিৎবাবুর এ দিনের কথাবার্তা শুনে তাঁদের কেউ কেউ আবার পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘উনিই বা কেন রাজনীতির চাপে মাথা নোয়ালেন?’’ কেন পদত্যাগ করলেন?’’ যাদবপুরের শিক্ষক সংগঠন জুটা-র সম্পাদক নীলাঞ্জনা সেনগুপ্তের পর্যবেক্ষণ, ‘‘অভিজিৎবাবুর আমলে যে আইসিসি ঠিক ভাবে তৈরি হয়নি, সেটা আমরা বলেছিলাম। তাই কোনও এক ঘটনায় ওই কমিটির রিপোর্ট সম্পর্কে আমাদের কিছু বলার নেই।’’