পুজোর দিনগুলি এগিয়ে আসতেই বাঙালিও সেজে ওঠে পুজোর সাজে। সেইউনিশ শতক থেকেই আগমনীর সুর সঙ্গে করে নিয়ে আসত কেনাকাটার ধুম। পাঁচ নম্বর দ্বারকানাথ টেগোর’স লেনের বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দায় জমে উঠত ভিড়। খবরের কাগজ ভাঁজ করে সরু ফিতের মতো বানিয়ে পায়ের মাপ নিয়ে জুতো বানিয়ে দিতেন চিনা জুতো-করিয়েরা। মাথায় গম্বুজের মতো টুপি পরা ওস্তাগর এসে, ছোটদের পুতুলের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পোশাকের মাপ নিয়ে ছেড়ে দিত। আসত বড়বাজারের পঞ্জাবি শালওয়ালা, জরির ছিট আর কিংখাবের পসরা নিয়ে। আতরের পসরা নিয়ে আসা ইহুদি গেব্রিয়েল সাহেবের কথাও আলাদা করে বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুজোয় ছোটদের বরাদ্দ ছিল নতুন কাপড় আর সিল্কের রুমাল। সেই রুমালও এনে দিতেন গেব্রিয়েল সাহেব।
পুজোর জুতো কিনতে কম্বুলিটোলার ছাপোষা বাবুরা ঢুঁ মারতেন বিডন স্কোয়ার অঞ্চলের মুচির দোকান বা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের চিনে দোকানে। নতুনবাজার বৌবাজার বড়বাজারের কাপড়পট্টিতে ঠাসা ভিড়ে তাঁদের কেনাকাটা। ১৮৫৭ সালের পর ঢাকার তাঁতিরা যে সিপাইপেড়ে শাড়ি-ধুতি বাজারে এনেছিল, সেই ফ্যাশন চালু ছিল পরের দশকেও। নানা রকমের পাড়ের সঙ্গে মানানসই উড়নি পছন্দ করতেন পুরুষরা। মেয়েদের জন্য ছিল রকমারি শাড়ির দীর্ঘ তালিকা। পছন্দের কাপড় বেছে নিতে দোকানি-খদ্দের দু’জনেরই মাথা ঘুরে যেত, জানিয়েছেন অমৃতলাল বসু।
পুজো এগিয়ে এলে বাড়ত শাঁখা-পলা আলতা-সিঁদুর নিয়ে পাড়ায় ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা। ময়ূরমুখ, হংসমুখ, মকরমুখ শাঁখা ঘিরে বসতেন নানা বয়সের মেয়েরা। দরদাম করে কেনাকাটার পর হাতে হাতে উঠত নতুন শাঁখা-পলা। মুসলমান ফেরিওয়ালা ডেকে যেত, “বিলিতি চুড়ি চাই! সাবান চাই!” পুজোর পঞ্চমী-ষষ্ঠীর দিনে মেয়েদের সাজের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল বেলোয়ারি চুড়ি। হাত-ভরা গয়নার পরেও পুজোর সাজ সম্পূর্ণ করতে চুড়ি লাগতই। উনিশ শতকের কলকাতায় সচরাচর গৃহস্থবাড়িতে কারও পাঁচড়া হলে তবেই সাবান কেনা হত। তবে পুজোয় হাতে-মুখে মাখতে বিয়ের বয়সি মেয়ে ও বৌরা একটু সাবানের আবদার ধরতেন।
সেকালের ঘরোয়া রূপচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন নাপিত-বৌ। সারা বছর হপ্তায় হপ্তায় এলেও পুজোর ক’টি দিন তাঁর রোজ আসা চাই, বাড়ির মেয়েদের পা পরিষ্কার করে আলতা পরাতে। আশাপূর্ণা দেবী ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে দেখেছেন দক্ষ ‘নাপতিনী’কে। নতুন জুতোয় দাগ লেগে যাবে বলে তাঁর ছোট বোন আলতা পরতে চাইত না, নাপিত-বৌ পা টেনে নিয়ে বলত, “মেয়ের কথা শোনো! মেমসাহেব হবি নাকি?”
উপলক্ষ পুজো হলেও, কেনাকাটার এই উৎসবের অংশ হতেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। সময় বদলেছে, চিনা ও ইহুদিরা শহর থেকে প্রায় হারিয়ে গেছেন, সেই শাঁখাওয়ালা কি নাপিত-বৌয়েরা কোথায়? হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের পুজো-বাজারের ভিড়ে ভাগ বসিয়েছে শপিং মল। ছবিতে নব্বই দশকে গড়িয়াহাটের পুজো-বাজারের চিত্র।
শিল্প ও শুভ
সাকুল্যে ইঞ্চি ছয় উচ্চতা। এতটুকু দুর্গাঠাকুর, নতজানু মহিষাসুর সেই অনুপাতেই ছোট, দুর্গার বাহন সিংহও। অথচ প্রত্যেকেই ছুঁয়েছে অনুপম শিল্পসুষমা। দুর্গার দিকে তাকালে আবার দেখা যাবে তাঁর একটি অংশ শ্যামবর্ণা, মুণ্ডমালিনী কালী— একটি মুঠিতে তিনিই ধরে আছেন মহিষাসুরের উদ্ধত কেশগুচ্ছ! বনহুগলির রাইমোহন ব্যানার্জি রোডের বাসিন্দা হরিসাধন বিশ্বাস প্রতি বছর পুজোর আগে একটি ছোট্ট ঠাকুর গড়েন, পুজোর হুল্লোড়ে প্রদর্শনের জন্য নয়, আপন আনন্দে— এ বার গড়েছেন এটি (ছবি)। চার পাশের অশুভের বিনাশে এই দুর্গাকালী রূপেরই আবাহন জরুরি মনে হয়েছে তাঁর, সেই ভাবনাই রূপ পেয়েছে মাটি আর অ্যাক্রিলিক রঙের যুগলবন্দিতে। ২০০৪ সাল থেকে চলছে এই চর্চাটি, এক-এক বছর এক-এক অভাবনীয় উপকরণে: নানা ফুলের পাপড়ি ও বীজ, পেঁয়াজ-রসুনের খোসা, গ্যাসের পাইপ ও তারের টুকরো দিয়ে, এমনকি আনন্দবাজার পত্রিকা খবরকাগজ দিয়েও। বাড়িটিই ওঁর সংগ্রহশালা।
আজও প্রাসঙ্গিক
ষাটের দশকে বাদল সরকার লিখেছিলেন পাগলা ঘোড়া। আজও প্রাসঙ্গিক এ নাটক, কারণ নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবিচারের ছবি আজও পাল্টায়নি। নাটকের সেই সংলাপ, “মেয়েটার একমাত্র দোষ হল, সে মেয়ে!”, এই সময়েরও স্বর। এ নাটকে তিন নারীর আত্মহত্যা শুধুই ব্যক্তি-ট্র্যাজেডি নয়, পিতৃতান্ত্রিক দমন, মধ্যবিত্ত অন্ধকারেরও প্রতিচ্ছবি। এই নারীরা ভালবাসা চেয়েছিল, পেয়েছে শুধুই প্রতারণা, মৃত্যু। বাদল সরকারের শতবর্ষে ‘রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ুধ’ মঞ্চে আনছে পাগলা ঘোড়া, সম্পাদনা ও নির্দেশনায় দানী কর্মকার। ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টায়, গিরিশ মঞ্চে।
দুয়ারগুলি
বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার জনপরিসরে যেমন চর্চিত, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক স্তরেও। প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবীর যুগ থেকে আজকের সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত চিত্রপরিচালকদের কাহিনি ও চরিত্রের আবেগকে দিয়েছে স্ফূর্তি, গতি। সত্যজিৎ রায় তপন সিংহ তরুণ মজুমদারের ছবিতে রবীন্দ্রগানের প্রয়োগ বাঙালির সমষ্টিস্মৃতির অংশ, ঋত্বিককুমার ঘটকও তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গানকে দিয়েছেন এক অনন্য মাত্রা, দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে যুগলবন্দিতে তা হয়েছে কিংবদন্তি। ৪৬, পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের ঘোষবাড়িতে (ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ঘোষের গৃহ) আগামী কাল, রবিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় ‘ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নিয়ে বলবেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, পরে বিশাখদত্তের আগমনী গান— সুতানুটি পরিষদ চোরবাগান অঞ্চলের উদ্যোগে।
চতুর্থ বছরে
তিন বছর পেরিয়ে এ বার চতুর্থ বছরে ‘সত্যজিৎ চৌধুরী স্মারক-বক্তৃতা’। কলকাতার অদূরেই, নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পৈতৃক বসতবাটীতে এখন যে বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রের অধিষ্ঠান, তার হয়ে ওঠার পিছনে ছিল সারস্বত মানুষটির অক্লান্ত নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের যোগ, তাঁরই স্মরণে এই বক্তৃতা-উদ্যোগের তাই সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এ বারের অনুষ্ঠান আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টেয়, বঙ্কিম-ভবনের সঞ্জীবচন্দ্র সভাগৃহে। বিষয়টিও আকর্ষক— ‘সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে হাস্যরস’। বলবেন বিশিষ্ট তথ্যচিত্র-নির্মাতা অভিজিৎ দাশগুপ্ত। এই অনুষ্ঠানেই পুনঃপ্রকাশ হবে জরুরি একটি বইয়ের— সত্যজিৎ চৌধুরী দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও নিখিলেশ্বর সেনগুপ্ত সম্পাদিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী স্মারকগ্রন্থ।
স্মৃতি-প্রদর্শনী
পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছাড়াই ছবি তুলেছিলেন ‘গুগাবাবা’র। মন দিয়ে দেখে সত্যজিৎ রায়ের প্রশ্ন, “কে তুলেছে?” বংশী চন্দ্রগুপ্ত নিমাই ঘোষকে দেখিয়ে দিতে, বললেন, “আপনি তো মশাই আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছেন।” অরণ্যের দিনরাত্রি-র সময় হঠাৎ ফোন, “নিমাই, পারলে আউটডোরে চলে এসো।” সত্যজিতের ‘ফোটো-বায়োগ্রাফার’ নিমাই ঘোষের সঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’-এর যোগসূত্রটি সৌম্যেন্দু রায়; তাঁর থেকেই নিমাই ঘোষের তোলা জয় বাবা ফেলুনাথ ছবির ৮টি ‘কন্ট্যাক্ট শিট’ আসে তাদের সংগ্রহে। ২১-২৮ সেপ্টেম্বর, বেলা ১২টা-৪টে ভদ্রকালীর ৭০ রাম-সীতা ঘাট স্ট্রিটে আর্কাইভ-কক্ষে নিমাইবাবুর স্মৃতিতে প্রদর্শনী: থাকবে জয় বাবা ফেলুনাথ-এর পোস্টার, পুস্তিকা, বিজ্ঞাপনও। মলয় রায় ও সাত্যকি ঘোষ ভূষিত হবেন এ বছরের জীবনস্মৃতি সম্মাননায়।
রূপচরিতমহিমা
দেবী দুর্গাকে নিয়ে কাহিনির যেমন শেষ নেই, তেমনই সেগুলিতে তাঁর রূপবর্ণনারও অন্ত নেই। এক কথায় তিনি বহুরূপিণী। দেবীর নানা রূপ বাঙালির শাস্ত্রে আচারে মানসপটে বহুকাল ধরে প্রচলিত— প্রাচীন কাল থেকেই সেই রূপকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য, আঁকা হয়েছে কতশত ছবি। যেমন, তিনি কখনও শস্যদায়িনী, কখনও মহিষাসুরমর্দিনী বা অসুরনাশিনী, কখনও সিংহবাহিনী, আবার কখনও চামুণ্ডা বা চণ্ডীরূপী। দেবীর এহেন বহুরূপ ফুটে উঠেছে শিল্পী দেবাশীষ মল্লিক চৌধুরীর রেখাচিত্রে। তাঁর আঁকা দেবীর বিভিন্ন রূপের পঞ্চাশটি চিত্রকৃতি নিয়ে ‘দুর্গতিনাশিনী’ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে গতকাল, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। চলবে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিকেল ৩টে থেকে রাত ৮টা। ছবিতে তারই একটি, প্রচারপত্র থেকে।
শিল্পরূপেণ
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, গোলপার্কে ‘হেরিটেজ অ্যান্ড উই কলকাতা’ ও মিশন কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে চলছে প্রদর্শনী, ‘মহামায়া’। এ রাজ্যের ৩২ জন সংগ্রাহকের সংগ্রহে থাকা পুস্তিকা, ডাকটিকিট, বিভিন্ন মাধ্যমে তৈরি মূর্তি ও ভাস্কর্য, পেন্টিং, লিথোগ্রাফ, ওলিগ্রাফ, চালচিত্র, বিজ্ঞাপন, গ্রন্থ, জনজাতি চিত্রের মূল্যবান সংগ্রহ-সম্ভার (ছবি) দেখা যাবে সেখানে, নানা মাধ্যমে আঁকা প্রাচীন ও তুলনায় নতুন পটও। শিল্প-ইতিহাসবিদ অসিত পাল থাকছেন তাঁর সংগ্রহ নিয়ে। রয়েছে পুজোর বিভিন্ন উপকরণও। মুদ্রায় তুলে ধরা হয়েছে মহিষমর্দিনীর কথা ও কাহিনি: দেবীর নানা রূপ, তাঁর বাহন, তাঁর পরিবার, তাঁর পূজা, সব কিছুই। প্রদর্শনীটি কিউরেট করছেন সংগ্রাহক ও ফিলাটেলিস্ট সৌভিক রায়। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি দেখার সুযোগ আজ পর্যন্তই, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা।
সোজাসাপটা
পুরোদস্তুর কলকাতায় থেকে বিশ্বের সমাজবিজ্ঞান-চর্চায় ছাপ ফেলতে পেরেছেন, এমন বাঙালি ক’জন? রণবীর সমাদ্দার যেমন দিল্লি-মুম্বইয়ের বিদ্বৎসমাজে চর্চিত, তেমনই প্যারিস-ভিয়েনায় তাঁকে শুনতে হাজির হয় পশ্চিমি মহল। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেছেন, নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেয়েছেন চেয়ার প্রফেসর সম্মান। আর অক্লান্ত নিষ্ঠায় নিজের শহরে গড়ে তুলেছেন ‘ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ’। সাংবাদিক গবেষক সমাজকর্মীদের দেওয়া রণবীরবাবুর সাতটি সাক্ষাৎকারের সঙ্কলন সোজাসাপটা রণবীর সমাদ্দার (প্রকা: সম্পর্ক) প্রকাশ পেল গত ১০ সেপ্টেম্বর, শহরে এক অনুষ্ঠানে। যাঁকে ঘিরে এত কিছু তিনি এ দিন বললেন অল্পই, তারও মধ্যে উঠে এল কলকাতার প্রতিবাদী চরিত্রের কথা, তা সে ষাটের দশকেই হোক বা বিশ্বায়ন-উত্তর। পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন, পাল্টে যাওয়া মহানগরের ছবি এবং হিন্দুত্ব বনাম আঞ্চলিক রাজনীতির লড়াইয়ের রূপরেখা ফুটে উঠল মৈনাক বিশ্বাস সমীর দাস অন্বেষা সেনগুপ্ত শুভজিৎ বাগচির কথায়, সুনন্দন রায়চৌধুরীর সমন্বয়ে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)