Advertisement
E-Paper

কী খাওয়াচ্ছেন বাচ্চাদের? ভেবে খাওয়ান কিন্তু!

শহরের এক নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র জিকো। বাড়ির খাবার মুখে রোচে না কিছুতেই। স্কুলের টিফিনে পিৎজা বা বার্গার না থাকলে বড়ই বিরক্ত হয় সে। তার ওজনও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। অল্পেতেই হাঁফিয়ে যেত সে। চিকিৎসক জানালেন, রীতিমতো উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে ১২ বছরের জিকো। দায়ী অতিরিক্ত ওজন।

সৌভিক চক্রবর্তী ও মধুরিমা দত্ত

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ১৬:৫৩
—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শহরের এক নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র জিকো। বাড়ির খাবার মুখে রোচে না কিছুতেই। স্কুলের টিফিনে পিৎজা বা বার্গার না থাকলে বড়ই বিরক্ত হয় সে। তার ওজনও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি। অল্পেতেই হাঁফিয়ে যেত সে। চিকিৎসক জানালেন, রীতিমতো উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে ১২ বছরের জিকো। দায়ী অতিরিক্ত ওজন।

ক্লাস সেভেনের ছাত্রী মধুমিতাও খুব পছন্দ করত ভাজাভুজি। বাড়ির সাধারণ খাবারে তার দারুণ আপত্তি। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে একটুখানি কেটে গিয়েছিল। কিন্তু সাতদিন পরেও ক্ষত না শুকোনোয় মধুমিতার মা,বাবা তাকে নিয়ে গেলেন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক জানালেন, এইটুকু বয়সেই ডায়াবেটিসের শিকার মধুমিতা। এ ক্ষেত্রেও দায়ী সেই খাদ্যাভ্যাস এবং অতিরিক্ত ওজন।

শুধু জিকো বা মধুমিতাই নয়, ইদানীং এই ধরণের ঘটনা হামেশাই দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদের মধ্যে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন অতিরিক্ত ওজনের জন্যই বাচ্চাদের দেহে চুপিসাড়ে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন মারাত্মক ব্যাধি। শুধু উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসই নয়, স্থূলতার কারণে অল্পবয়সেই দেখা দিতে পারে যকৃৎ বৈকল্য থেকে ক্যানসার পর্যন্ত।

সম্প্রতি বিশ্ব স্থূলতা দিবস উপলক্ষ্যে কলকাতার এক নার্সিংহোমে আয়োজিত একটি কর্মশালায় এ বিষয়ে শহরের স্কুলগুলিকে এবং অভিভাভকদের সতর্ক করলেন চিকিৎসকেরা।

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ এস্থেটিক প্লাস্টিক সার্জনস-এর সভাপতি মনোজ খান্না জানান, ২০২৫ সালের মধ্যেই ভারতে স্থূলতা মহামারীর আকার নিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের ক্যান্টিনে পিৎজা, বার্গার বা ঠান্ডা পানীয় থাকলেই বাচ্চারা সে দিকে আক়ৃষ্ঠ হবে। আর তাতেই শরীরে ঢুকবে অপ্রয়োজনীয় ক্যালোরি। তবে শুধু স্কুল নয়, অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’’

চিকিৎসকদের মতে, ওজন বেশি থাকলে ৩ থেকে ৯ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বড় হয়ে স্থূল হওয়ার সম্ভাবনা যেখানে ৪০% সেখানে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা প্রায় ৭০%।

কিন্তু কেন বাড়ছে স্থূলত্ব?

বেরিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সরফরাজ বেগ জানালেন, এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী খাদ্যাভ্যাস। ইদানীং বিজ্ঞাপনের দৌলতে বদলে যাচ্ছে বাচ্চাদের রুচি। ঘরের সাদামাটা খাবারের চেয়ে তারা অনেক বেশি পছন্দ করছে বাইরের ‘জাঙ্ক ফুড’ এবং বিভিন্ন আইসক্রিম ও চকোলেট। বাবা, মায়েরাও হামেশাই বাচ্চাদের কিনে দিচ্ছেন এই ধরণের খাবার। আর এতেই শরীরে জমছে মারণ ফ্যাট। তিনি আরও জানান, কিছুদিন আগে পর্যন্তও বাচ্চারা নিয়মিত মাঠে ঘাটে খেলাধূলো করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভ্যাসটাও একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন স্কুল থেকে ফিরেই বাচ্চারা বসে পড়ে টিভি কিংবা কম্পিউটারের সামনে। ফলে শরীরচর্চার অভাবেও বাড়ছে স্থূলত্ব। তিনি বলেন, ‘‘সামান্য সচেতনতার অভাবেই ঘরে ঘরে বাসা বাঁধছে স্থূলত্বের মতো সমস্যা।’’

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, গরিব দেশগুলিতে যত না মানুষ অপুষ্টিতে মারা যায় স্থূলত্বের কারণে মারা যায় অনেক বেশি। তাঁরা বলেন, ‘‘স্থূলত্ব কোনও রোগ নয় তবে স্থূলত্ব ডেকে নিয়ে আসে বহু মারাত্মক ব্যাধি।’’

কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও বাচ্চাদের টিফিন বাক্সের ছবিটা ছিল অন্য। বাড়িতে হাতে তৈরি রুটি, মুড়ি, পাউরুটি, ফলে সাজানো টিফিনবাক্সই যে বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের সহায়ক ছিল মেনে নিচ্ছেন ডায়াটিশিয়ানরাই। ডায়াটিশিয়ান কল্পনা চৌধুরি বলেন, ‘‘মা ঠাকুমাদের তৈরি খাবারে আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদাটুকু মিটে যেত। শুক্তো বা বিভিন্ন সবজি দিয়ে রাঁধা তরকারি, মাছ, ডাল এগুলো একটা বাচ্চার স্বাস্থ্য গঠনের প্রাথমিক স্তম্ভ।’’ সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে সসেজ, প্যাকেটের মাংসতে বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকি। রাসয়নিক ব্যবহার করে সংরক্ষণ করা যে কোনও রকম খাবার পারতপক্ষে এড়িয়ে চলার দিকেই মত ‘হু’র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে যে কোনও উত্সবে অনুষ্ঠানে রেঁস্তোরায় খাওয়ার হিড়িক। এবং সেই মেনুতে মানুষের পছন্দের প্রথমসারিতে থাকা খাবার গুলোতে লুকিয়ে আছে মোটা হওয়ার যাবতীয় ‘রসদ’ —মনে করছেন পুষ্টিবিদরা।

কিন্তু একটু সচেতন হলেই এই ধরণের সমস্যা এড়ানো যায় বলেই মনে করছেন মনোজবাবু এবং সরফরাজবাবু। ওই কর্মশালাটিতে তাঁরা বাচ্চাদের অভিভাবকদের এবং স্কুলগুলিকে প্রধানত দু’টি বিষয়ে সচেতন হওয়ার কথা বলেছেন। তাঁরা স্কুলগুলিকে অনুরোধ করেছেন ক্যান্টিনে যাতে কোনওরকম ‘জাঙ্ক ফুড’ না রাখবার জন্য এবং স্কুলের ভিতরে প্যাকেটজাত খাবার নিষিদ্ধ করার জন্য। তাঁদের মত, প্যাকেটজাত খাবারে বদলে স্কুলগুলিতে ফল, ডিম বা দুধ মজুত রাখতে হবে। তার পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য শারীরশিক্ষা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা। স্কুলের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মোটা হওয়ার সমস্যা শুরু হয় একেবারে নার্সারির সময় থেকেই। এক ডায়টিশিয়ান জানান, ‘‘বিভিন্ন সমীক্ষা করতে গিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে গিয়ে দেখেছি স্কুল কর্তৃপক্ষই অভিভাবকদের বলছেন বাচ্চাদের চিপস বা কেকের প্যাকেট দিয়ে পাঠাতে। তাতে টিফিন খাওয়ার সময় অনেকটা কম লাগে, ঝামেলাও কম। পুষ্টি স্বাস্থ্য কোনওটাকেই গুরুত্ব দেওয়ার ধারও ধারে না খোদ স্কুল কর্তৃপক্ষই।’’ বহুবার স্কুলের সামনে এবং স্কুল সংলগ্ন আশেপাশের এলাকাতে ফাস্টফুড বা জাঙ্কফুড বিক্রির নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এখনও দুপুর বেলা টিফিনের সময় স্কুলের দরজার সামনে ফুচকা, চাট, বরফ গোলা, চাউমিন বিক্রেতাদের সামনে চোখে পড়ে স্কুল পড়ুয়াদের লম্বা লাইন। টাকি বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরেশ কুমার নন্দ বলেন, ‘‘স্কুলে এখন মিড ডে মিল চলছে। কিন্তু একজন শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টির ন্যূনতমটাও পূরণ হয়না মিড –ডে মিলের খাবারে। আর স্কুলের বাইরে মুখরোচক খাবার বিক্রি না করার নিয়ম রয়েছে তবে, এখন নিয়ম তো তৈরিই হয় ভাঙার জন্য। এক্ষেত্রেও তাই।’’ একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অবশ্য স্কুলের তরফে বাচ্চাদের অভিভাবকদেরকে সচেতন করার দিকেই নজর দেওয়ার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলে বাচ্চারা একটা বড় সময় কাটায় ঠিকই, কিন্তু স্বাস্থ্যগঠনের প্রথম পাঠটা শুরু হয় বাড়ি থেকেই।’’

ডায়াটিশিয়ান কল্পনা চৌধুরির পরামর্শ, ‘‘ফাস্টফুড গুলোই যদি বা়ড়িতে নিজের মতো রান্না করে নেওয়া যায় তাহলে তা স্বাস্থ্যকরও হবে, মুখরোচকও। বাচ্চাদের পছন্দসই।’’ এই বিষয়ে সিংহভাগ দায়িত্ব যে বর্তাচ্ছে বাচ্চার অভিভাবকের উপর তা মেনে নিয়েই সরফরাজবাবু বলেন, ‘‘ প্রথমেই সবচেয়ে বেশি সতর্ক হতে হবে অভিভাবকদের। বাড়িতে ভাজাভুজি জাতীয় খাবার যথাসম্ভব কম খেতে হবে। ফল বা সেদ্ধ জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে। বাচ্চা বায়না করবেই। কিন্তু সবসময় সেটা শুনলে হবে না। আর নিয়মিত খেলাধুলো করার উৎসাহ দিতে হবে।’’ কিন্তু বাড়ির খাবারও যে সম্পূর্ণ নিরাপদ এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই জানাচ্ছেন কল্পনা চৌধুরি। এখন বাড়িতে রান্না করার দায়িত্ব বেশিরভাগই দেওয়া হয় কোনও পরিচারিকার উপর। ‘‘ছোট পরিবার, চাকুরিরত বাবা, মা, সন্তানের সংসারে সেই দায়িত্বভাগে কিছুটা সময় বাঁচতে পারে কিন্তু আখেরে সমস্যা ডেকে আনে শরীরে। চটজলদি খাবার বানানোর জন্য রান্নার লোকটি অতিরিক্ত তেল, মশলা দিয়ে রান্না করছেন। তাতে শুধু মোটা হওয়া নয়, নানান রোগের ডিপো হয়ে উঠছে শরীর।’’

তবে স্কুল হোক বা অভিভাবক! সব ছাপিয়ে স্বাস্থ্য তৈরিতে যে খোলা মাঠে নিয়মিত খেলাধুলোর কোনও বিকল্প নেই— এই সার সত্যেই একমত পোষণ করছেন চিকিত্সকরা।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy