মঞ্চে উদ্বিগ্ন কৌশিক সেন। নীচে সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুমন বল্লভ।
মঞ্চে নাটক চলছে। দর্শকাসনে টানটান উত্তেজনা। সেই নাটকীয়তাকে হার মানিয়ে উপরে পর্দা থেকে ঝলকে উঠল আগুন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বড়সড় দুর্ঘটনার হাত থেকে কান ঘেঁষে বাঁচল কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস মঞ্চ। নাট্যকর্মী এবং দর্শকদের একাংশই প্রাথমিক ভাবে অবস্থাটা সামাল দেন। পরে দমকলের দু’টি ইঞ্জিন পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। তবে ধোঁয়া ও আতঙ্কে কয়েক জন নাট্যকর্মী অসুস্থ হয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাঁদের চিকিৎসা করানো হয়েছে।
দমকলের সূত্রের খবর, আপাত ভাবে শর্ট সার্কিট থেকেই আগুন লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মঞ্চের উপরে আলো তেতে গিয়ে পর্দার সংস্পর্শে এসে আগুন লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এখনও পর্যন্ত এই ঘটনায় কারও গাফিলতি চিহ্নিত করে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার কথা তাঁরা ভাবছেন না।
এ দিন একই সঙ্গে দু’টি নাটিকার অভিনয় ছিল। প্রথমে কৌশিক সেনের নির্দেশনায় ‘পুনশ্চ’। তার পর সুমন মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘শূন্য শুধু শূন্য নয়’। সেই নাটিকারই একটি দৃশ্যে অভিনয় করতে করতে অভিনেত্রী তূর্ণা দাস উপরে তাকিয়ে দেখেন, মঞ্চের ডান দিকের পর্দা (মিড কার্টেন) থেকে আগুন ঝরছে। মুহূর্তের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে প্রেক্ষাগৃহে।
ঘটনাচক্রে সুমন এবং কৌশিক দু’জনেই বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন। নাট্যজগতে শিবির-বিভাজনও এই মুহূর্তে তুঙ্গে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের নাট্যাভিনয়ের মাঝপথে এমন ঘটনায়, নানা মহলে নানা সন্দেহও দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তবে সুমন এবং কৌশিক এখনই এর মধ্যে চক্রান্তের ছায়া খুঁজতে রাজি নন। ঘটনাটিকে শুধু এক ‘রহস্যজনক সমাপতন’ হিসেবেই বর্ণনা করছেন ওঁরা। সুমনের কথায়, “বহু দিন বাদে কৌশিক ও আমি একসঙ্গে নাটক করছিলাম। কী ভাবে এমনটা ঘটল, মাথায় ঢুকছে না।”
তবে নাট্যজগতের অনেকে বলছেন, সম্প্রতি এগ্জিকিউটিভ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতভেদের জেরে অ্যাকাডেমির অছি পরিষদের (বোর্ড অব ট্রাস্টি) সদস্যরা পদত্যাগ করার পর প্রেক্ষাগৃহের দেখভালে কিছু সমস্যার জন্ম হয়েছে। ক’দিন ধরেই প্রেক্ষাগৃহের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নিয়ে উপর্যুপরি সমস্যা হচ্ছিল বলেও অভিযোগ।
তা ছাড়া অ্যাকাডেমির নিয়মিত নাট্যদর্শক-নাট্যকর্মীদের একটা বড় অংশেরই বক্তব্য, যে কোনও দিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে অপরিসর জায়গার মধ্যে কী ভাবে তা সামাল দেওয়া যাবে, সে আশঙ্কা তাঁদের ছিলই!
কেন?
দীর্ঘ চার দশক ধরে নাটকের অভিনয় হচ্ছে এই মঞ্চে। বর্তমানে কলকাতার নাট্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু এই মঞ্চ। নিয়মিত বিপুল দর্শকের সমাগম হয়। অথচ একতলায় একটি মাত্র অপ্রশস্ত দরজাই ঢোকা-বেরনোর জন্য খোলা থাকে। কোনও দিন কোনও বিপদ ঘটলে লোকজনকে নিরাপদে বের করে আনাটাই যে বিরাট সমস্যার জন্ম দিতে পারে, এ কথা হামেশাই নাট্যজগতের অন্দরে আলোচিত হয়ে থাকে। চেয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সরু জায়গায় ঠেলাঠেলিতে পদপিষ্ট হয়ে মানুষ আহত হতে পারেন, দমবন্ধ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন এমন বহু সম্ভাবনার কথাই সে সব আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু দিল্লির ‘উপহার’ সিনেমা হলের ঘটনা, কলকাতার বুকে স্টিফেন কোর্ট-নন্দরাম মার্কেটের মতো মারাত্মক সব অগ্নিকাণ্ড পরপর ঘটে যাওয়ার পরেও অ্যাকাডেমির মতো প্রেক্ষাগৃহের কোনও সংস্কার হয়নি।
এ দিনও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, আগুন লাগার পরে দর্শকদের বার করতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। ভিড়টাসা একতলায় প্রাণভয়ে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলির চোটে কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তখন প্রেক্ষাগৃহের পিছনে বহু বছর ধরে বন্ধ থাকা আর একটি দরজা খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু মরচে পড়া সে তালা খুলতে হিমসিম খেয়ে যান হলের কর্মীরা। দোতলাতেও একটিই দরজা। সেখানেও আতঙ্কের আঁচ পৌঁছে যায়।
তবে শেষমেশ বড় ধরনের বিপদ ঘটেনি। অভিনেত্রী তূর্ণা, নবনীতা বসু মজুমদার প্রমুখ কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁদের আঘাত গুরুতর নয়। অভিনেতা বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে আলোকশিল্পী দীপঙ্কর দে সকলেই পরিস্থিতি সামলাতে হাত লাগান। নাটক দেখতে এসে অভিনেতা দেবদূত ঘোষ, নাট্যপরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় দর্শকদের বাইরে বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুমন ও কৌশিক দু’জনেই বলছিলেন, “এত জন নাট্যকর্মী একসঙ্গে থাকায় সুবিধে হয়েছে। অ্যাকাডেমির ঘাঁতঘোঁত সবারই জানা। ফলে উদ্ধারকাজ থমকায়নি।”
কিন্তু এ দিন বিপদ কাটলেও ভবিষ্যতে সুরক্ষার বন্দোবস্ত কী হবে, তা নিয়ে কোনও উত্তর মেলেনি। এগ্জিকিউটিভ কমিটির সহ-সভাপতি অসিত পালের অভিযোগ, “প্রেক্ষাগৃহে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আরও ভাল করতে ট্রাস্টিদের সাহায্য চেয়েছিলাম। সব টাকা ওঁদেরই জিম্মায়। ওঁরা সাহায্য না-করলে সংস্কার সম্ভব নয়।” প্রেক্ষাগৃহের কেয়ারটেকার বিমল দে-র অবশ্য দাবি, হলে রাখা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার করেই তাঁরা পরিস্থিতি সামলান। পরে দমকল আসে!
কিন্তু নাট্যকর্মীদের অনেকেরই বক্তব্য, শুধুমাত্র অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা রাখাটা তো একমাত্র বিচার্য নয়! অগ্নি-সুরক্ষার অন্যান্য নিয়ম-সতর্কতা মানা হচ্ছে কি না, ঢোকা-বেরনোর উপযুক্ত জায়গা রাখা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়া দরকার। প্রশাসনও নজরদারির দায় এড়াতে পারে না। কৌশিক সেন দাবি তুলছেন, “প্রেক্ষাগৃহের দেখভালের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে এটির নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে।”
এর পরে অ্যাকাডেমিতে ফের কবে নাটক হবে, সেটা অনিশ্চিত। আপাতত নাট্যমোদীদের মুখে মুখে ঘুরছে, সুমন মুখোপাধ্যায়ের নতুন নাটকের নাম। ‘যারা আগুন লাগায়!’ সেই সুমনের নির্দেশনাতেই অন্য একটি নাটকে এই অগ্নি-কাণ্ড নাটকীয় মাত্রা যোগ করল। এও সমাপতন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy