তৃপ্তি: উদ্বৃত্ত খাবারে পথশিশুদের ভোজ। গড়িয়াহাট উড়ালপুলের নীচে। নিজস্ব চিত্র
বিভিন্ন কোম্পানির ক্যান্টিন, ব্যারাকের রোজকার উদ্বৃত্ত ভাল খাবার কলকাতার বিভিন্ন জায়গার পথশিশুদের কাছে পৌঁছে দিই গত কয়েক বছর ধরে। ওদের কেউ কাজ করে, কেউ ভিক্ষা, কেউ ছোটোখাটো জিনিসের সাথে বেচে নিজের দেহও। রোজ এই খাবারের জোগান মেলায় ওদের অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়েছে, বন্ধ করেছে অপরাধমূলক কাজ। পুরসভার স্কুলে পাঠানো সম্ভব হয়েছে কিছু জনকে। আসলে খিদে ভাল-মন্দ বিচার না করে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে মানুষকে। সমীক্ষার পর সমীক্ষা হয়েছে এই শিশুদের নিয়ে। মানবাধিকার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির প্রতিনিধিদের সৌজন্যে জমা পড়েছে অনেক রিপোর্ট। কিন্তু কাজ এগোয়নি খুব বেশি। খিদিরপুর, গড়িয়াহাটের ফুটপাথে গেলেই দেখা যাবে প্রকৃত ছবিটা কেমন। মাঝেরহাট সেতু ভাঙার পরে অন্য সেতু-উড়ালপুলের তলার তুলনামূলক নিরাপদ আশ্রয় থেকে অনেককেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই রোদে খোলা আকাশের নীচে থাকছে বহু শিশু। গরিবি হটানোর থেকে গরিব হটানো আসলে অনেক সহজ। তাই আগামী সরকারের কাছে আশা অনেক।
শহরের এক প্রান্তে অনেক বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা রয়েছে। অন্য প্রান্তে আছে বন্দর ও বহু উৎপাদনকারী সংস্থা। তাদের সকলেরই রয়েছে মোটা অঙ্কের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ফান্ড (কর্পোরেট সংস্থার সামাজিক দায়িত্ব তহবিল)। ওই সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দেওয়া হোক পথশিশুদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কাজ করার জন্য। শহরে আছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তাদের জাতীয় সমাজ কল্যাণ ইউনিট। তাদেরও উৎসাহ দেওয়া হোক পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে। সত্যিই কাজ করতে চাইছে যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো, তাদের সাহায্য করা হোক। তৈরি করা হোক যথেষ্ট সংখ্যায় ওপেন শেল্টার। যে শেল্টারগুলোয় পথশিশুদের শিক্ষা, খাদ্য ও স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর রাখা হবে। অতিরিক্ত খাবার, জামাকাপড়, খেলনা সহজেই এই বাচ্চাদের কাছে ওপেন শেল্টারের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারেন শহরবাসী। প্রচার করা হোক এই বিষয়টি নিয়েও।
সারা পৃথিবীতে যত শিশু অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগে তাদের অর্ধেকের বাস ভারতবর্ষে। আর আমরা প্রতি বছর ৮৮০০০ কোটি টাকার খাবার নষ্ট করি। এই অঙ্কের ১০ শতাংশের পরিমাণ প্রায় ৯০০০ কোটি টাকা। আর এ দেশের মিড-ডে মিলের বাজেট ৯৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মিড-ডে মিলের বাজেটের প্রায় ১০ গুণ অর্থের খাবার প্রতি বছর
আমরা নষ্ট করে ফেলছি। এই বিপুল অপচয় বন্ধে আইন প্রণয়ন ও অতিরিক্ত খাবার ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো ও নীতি তৈরির দায়িত্ব নিতে হবে আগামী সরকারকে। সেই নীতি হতে হবে বাস্তববাদী। দুর্নীতি রুখতে কিছু ব্যবস্থা নিতে গিয়ে এমন নিয়ম যেন বানানো না হয়, যা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আসানসোল, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত জায়গায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এখনও বহু শিশুর আধার কার্ড হয়নি। ফলে মিড-ডে মিল ও অন্য সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। এই তালিকায় রয়েছে কলকাতা ও হাওড়ার পথশিশুরাও। এদের অধিকাংশেরই জন্মের শংসাপত্র নেই। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারেন জনপ্রতিনিধিরা। একটি বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী কলকাতা ও হাওড়ায় পথশিশুদের সংখ্যা প্রায় বাইশ হাজার। সারা বাংলায় সংখ্যাটা লক্ষাধিক। এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে উন্নত নয়, উন্নয়নশীল দেশ হয়েই থেকে যাব আমরা।
দ্য ন্যাশনাল আরবান হেলথ মিশনের নির্দেশিকায় শহরাঞ্চলে ‘আরবান হেলথ নিউট্রিশন ডে’-র পাশাপাশি বিশেষ শিবির আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। শহরের খালপাড়, উড়ালপুলের নীচে, রেললাইনের ধারে অপুষ্টিজনিত রোগে ভোগা শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ শিবিরের আয়োজন করে তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কথা। গ্রামে আশা কর্মীদের মতো শহরে এ কাজ করার কথা দায়িত্ব স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীদের। কিন্তু গ্রামে কিছুটা কাজ হলেও শহরে এই কাজ ঠিক ভাবে এগোচ্ছে না। গত মাসেই বেহালা ট্রাম ডিপো অঞ্চলে সৌরভ ভট্টাচার্য নামে এক পথশিশুর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পরে পথশিশুদের অপুষ্টির বিষয়টি আরও এক বার সামনে এসেছিল।
এই নির্বাচনে ধর্মবিশ্বাসের চেয়ে শিশুদের পুষ্টির বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিলে ভাল লাগত। যদিও বিষয়টি প্রায় কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারেই নেই। তবুও আশা করব নতুন সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাববে। এ নিয়ে কমিটি তৈরি হলে তাতে শুধু পছন্দমতো মানবাধিকার কর্মীদের না রেখে বৃহত্তর সমাজকে অংশীদার করা হবে হবে। কমিটির সদস্য করা হবে ফুটপাথবাসীদেরও। যতই কঠিন হোক, কাজটা করতে হবে। কারণ পথ কখনও একটি শিশুর বাসস্থান হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy