E-Paper

সতীর্থেরাই পুজোর ময়দানে একে অপরের প্রতিপক্ষ

শেষ কয়েক বছরে বি টি রোড সংলগ্ন ‘বরাহনগর ন’পাড়া দাদাভাই সঙ্ঘ’ বনাম ‘বরাহনগর নেতাজি কলোনি লো-ল্যান্ড’ যেন যুযুধান দুই পক্ষ।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৮
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

তাঁরা রাজনৈতিক সতীর্থ। হাতে হাত মিলিয়ে প্রায় সারা বছর রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দানে থাকেন। কিন্তু শারদোৎসবের প্রস্তুতি থেকে রেড রোডে কার্নিভালে যাওয়ার সুযোগ, সবেতেই একে অপরের প্রতিপক্ষ। কে কাকে কতটা টেক্কা দেবেন, তা নিয়েই চলে ঠান্ডা লড়াই। শহরের মন্ত্রী, নেতাদের এ হেন ‘লড়াই’ এখন ঢুকে পড়েছে শহরতলিতেও।

খুঁটি পুজো থেকেই শুরু সেই লড়াইয়ের। রাজনীতিতে এক সুর হলেও পুজোর প্রসঙ্গে প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে চাপা স্বরে তাঁরা বলেন, ‘‘এ বারে আমাদেরটা দেখবে। ওঁর থেকে অনেক ভাল।’’ কে কত আগে থিম প্রকাশ্যে আনবেন, তা নিয়েও থাকে প্রতিযোগিতা। অনুগামীদের কাছে ‘দাদা’র স্পষ্ট নির্দেশ থাকে, ‘থিম যেন কেউ না জানে।’ সেই পর্ব কাটিয়ে উদ্বোধন থেকে দর্শনার্থী টানার প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে শহরতলিতে।

শেষ কয়েক বছরে বি টি রোড সংলগ্ন ‘বরাহনগর ন’পাড়া দাদাভাই সঙ্ঘ’ বনাম ‘বরাহনগর নেতাজি কলোনি লো-ল্যান্ড’ যেন যুযুধান দুই পক্ষ। একই ভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের পারদ চড়ছে দক্ষিণেশ্বর, বেলঘরিয়া, সোদপুরেও। পুজোর দড়ি টানাটানিতে মুক্তি-আসন্ন বাংলা সিনেমার প্রচারও শহরতলির ‘দাদাদের’ উদ্বোধন মঞ্চের দখল নিচ্ছে। তবে, শুধু পদাধিকারীই নন, স্থানীয় রাজনীতিতে বিশেষ জায়গা পাওয়ার লড়াইয়ে পুজোর চমকদারিও যেন এখন আলাদা মাপকাঠি হয়ে উঠেছে।

বরাহনগরের এক পুজোর মূল উদ্যোক্তার কথায়, ‘‘কী করব, দাদাই তো প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে।’’ পাল্টা অন্য জন বলছেন, ‘‘পুজোয় প্রতিযোগিতা থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে বিভেদ নেই।’’ তবে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা থাকলেও একটি বড় পুজো আশপাশের পাড়ার মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করে বলে দাবি, রাজনীতির দৌড়ে থাকা ‘ছোট দাদাদের’।

প্রযুক্তির যুগে আজকের প্রজন্মের কাছে সম্পর্কের সুতো ক্রমশ আলগা হচ্ছে। সব কিছুই এখন বড্ড বেশি মুঠোফোনে, সমাজমাধ্যমে আবদ্ধ। তা-ও হৃদয়ের সম্পর্ক অন্য কথা বলে। সুতো, দড়ি, খড়, তার কিংবা বাঁশ দিয়ে সম্পর্কের বাঁধনের ‘টান’ এ বার ‘ন’পাড়া দাদাভাই সঙ্ঘ’-এর ভাবনা। জীবনের সমস্ত সম্পর্ককে এক সুতোয় বেঁধে মণ্ডপ সাজাচ্ছেন ব্যক্তিগত সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী, শিল্পী সন্দীপ মুখোপাধ্যায় ও তাপসী মুখোপাধ্যায়। ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা ও বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষের প্রতিবাদে সরব শাসকদল। পুজোর থিমেও তারই ছোঁয়া ‘নেতাজি কলোনি লো-ল্যান্ড সর্বজনীন’-এ। ডোকরা, ছৌ-নাচের মুখোশ, টেরাকোটা, পোড়া মাটির পুতুল, পটচিত্র, বেতের কাজ ও আলপনায় সাজছে মণ্ডপ। অরণ্যের পটভূমিতে গ্রামবাংলার জনজাতিদের জীবনযাত্রাও থাকছে। বিভিন্ন জেলার শিল্প-সংস্কৃতিকে বাংলা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি হিসাবে ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পী সৌরভ দত্ত।

একই ভাবে প্রতিবাদের সুর বাঁধতে গ্রামবাংলার হস্তশিল্প থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তিতে ‘নতুন গ্রাম’ তৈরি করছে পানিহাটির ‘শক্তিপুর সবুজ শিখা’ পুজো কমিটি। আবার, সংসারের ‘শক্তি’ মায়েদের জীবনের অনেকটা সময়ই কেটে যায় রান্নাঘরে। সন্তান থেকে পরিবারের সকলের মুখে খাবার তুলে দিতে তাঁদের প্রতি মুহূর্তের ঘাম-ঝরা কাহিনিই ‘দক্ষিণেশ্বর ডোমেস্টিক এরিয়া দুর্গাপুজো’র ‘মায়ের হেঁসেল’-এ দেখা যাবে। অন্য দিকে, প্রকৃতিতে প্রতিটি গাছই মাতৃ-সমানের ভাবনা তুলে ধরছে ‘বরাহনগর মল্লিক কলোনি সর্বজনীন’।

তবে মায়ের অঙ্গনে বাবার আত্মকথা বাদ যায় কেন? সেই ভাবনা থেকেই সোদপুর পানশিলা ঠাকুরবাড়ির নিবেদন ‘শ্রীচরণেষু বাবা’। হাজারো ঝড়-ঝঞ্ঝা সহ্য করে হাসিমুখে সন্তানকে আনন্দে রাখতে মরিয়া থাকেন বাবা। সংসারের সেই বাবাদের সুখ-দুঃখের কোলাজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে মণ্ডপে। যেখানে বাবার টানা-রিকশায় নিশ্চিন্তে সওয়ার দুর্গা ও তাঁর সন্তানেরা।কে কত ভিড় টানবে বা রেড রোডে কার প্রতিমা যাবে, এ সব লড়াইয়ের মাঝেই ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের অহিংসার বার্তা বেলঘরিয়ায়। জল, শব্দ-সহ জীবনের প্রতিটি তরঙ্গের মাঝেও ধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত শান্তির বাণীই প্রচার করছে ‘মানসবাগ সর্বজনীন’।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy