ঠাকুরমাকে খুন হতে দেখেছে সে। তাকেও খুনের চেষ্টা করেছিল দুষ্কৃতীরা। ঘটনার একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী বারো বছরের ওই মেয়েটি সামনে থেকেই দেখেছিল আততায়ীদের। চিকিৎসার পরে এখন সে সুস্থ। কিন্তু এমন এক জন প্রত্যক্ষদর্শী থাকা সত্ত্বেও রহস্য ভেদ হয়নি গার্ডেনরিচে বৃদ্ধা খুনের ঘটনার। সাড়ে পাঁচ মাসেও ধরা পড়েনি দুষ্কৃতীরা।
কলকাতা পুলিশের দক্ষতা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পুলিশেরই একাংশের অভিযোগ, খুনের ঘটনায় যুক্তদের বাঁচাতে চাইছেন তদন্তকারীরা। তাই যথেষ্ট প্রমাণ মেলার পরেও গ্রেফতার করা হয়নি কাউকে। ওই বৃদ্ধার পরিবারেরও অভিযোগ, প্রত্যক্ষদর্শী ওই কিশোরী বেশ কয়েক জনের নাম বলার পরেও পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেনি। লালবাজারের দাবি, তদন্তে ওই বৃদ্ধার পরিবারের সদস্যরা অসহযোগিতা করছেন। খুনিদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। পরিবারের সদস্যরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কয়েক জনের নাম বলেছেন বলে তদন্তকারীদের অনুমান। গোয়েন্দা প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ অবশ্য জানান, তদন্ত শেষ হয়নি। ওই খুনের কিনারা করার চেষ্টা চলছে।
২৫ ডিসেম্বর সকালে গার্ডেনরিচের রামনগর লেনের একটি ফ্ল্যাট থেকে ষাট বছরের জহুরা খাতুনের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পাশে গুরুতর জখম অবস্থায় পড়েছিল তাঁর নাতনি ফারিয়া। ফারিয়াকে একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে সে। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট থেকে পুলিশ জানতে পারে, বৃদ্ধার শরীরে ৩০টিরও বেশি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
কিন্তু প্রতক্ষ্যদর্শী থাকা সত্ত্বেও কেন এখনও ওই খুনের কিনারা করতে পারেনি পুলিশ? পুলিশ সূত্রে খবর, বৃদ্ধার নাতনি খুনিদের সম্পর্কে এক-এক সময়ে এক-এক রকম বয়ান দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বৃদ্ধার ছেলেরাও সহায়তা করছে না বলে পুলিশের দাবি।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের নাতনি ফারিয়া জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ে জানিয়েছিল, ঠাকুরমার দুই আততায়ীর মুখ ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা। হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র। এক জন মহিলা, অন্য জন পুরুষ। কথা বলছিল হিন্দি টান মেশানো বাংলায়।
কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরেই বেবাক বদলে যায় সেই নাতনির বয়ান। পুলিশের বক্তব্য, এখন সে আততায়ী হিসেবে নাম করেছে কয়েক জনের, যাঁদের সঙ্গে নিহত বৃদ্ধার পরিবারের বিবাদ রয়েছে দীর্ঘ দিনের। এ ছাড়া ওই আততায়ীরা দক্ষিণের একটি ভাষায় কথা বলছিল বলে ফারিয়া তদন্তকারীদের জানিয়েছে।
পুলিশের দাবি, পরিবারের সদস্যদের একাংশের নির্দেশ মতো ওই কিশোরী বয়ান বদাচ্ছে। ফারিয়া যাদের নাম বলেছে, ওই খুনের সঙ্গে তাঁদের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ বা যোগসূত্র প্রাথমিক ভাবে পাননি তদন্তকারীরা। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, জহুরা খাতুনের টাকা খাটানোর ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসার সূত্রে যাঁর যাঁর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল, তাঁদের নামই ওই কিশোরী বলেছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি বলেই পুলিশের দাবি।
পুলিশ জানিয়েছে, জহুরা খাতুনের তিন ছেলে। এর মধ্যে মেজো ও ছোট ছেলে তাঁদের পরিবার নিয়ে বৃদ্ধার ফ্ল্যাটের পাশের অন্য একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। জহুরার বড় ছেলে রহমতুল্লা থাকেন অন্য বাড়িতে। জহুরার ছেলের মেয়ে এই ফারিয়া।
খুনের ঘটনার পরেই নিহত বৃদ্ধার তিন ছেলের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, বৃদ্ধার ছোট ছেলে শামিমুল্লার কথায় বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।
লালবাজার সূত্রের খবর, বৃদ্ধার ছোট ছেলে প্রথমে জানিয়েছিলেন, তাঁর গাড়ির ব্যবসা রয়েছে এবং একটি গাড়ি মাঝরাস্তায় খারাপ হয়ে যাওয়ায় ঘটনার পরে ভোরে সে বাড়ি ফেরে। তার পরে সে আর না ঘুমিয়ে জেগে ছিল। ওই দিন সকালেই উদ্ধার হয় জহুরার রক্তাক্ত দেহ। পুলিশ সূত্রের খবর, পরে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, সে দিন গাড়ি খারাপের কোনও ঘটনা ঘটেনি। তা ছাড়া বাকি রাত শামিমুল্লা না ঘুমিয়ে থাকলে খুনের সময় জহুরার চিৎকার শুনতে পেলেন না কেন? সেই প্রশ্নেরও উত্তর পাননি তদন্তকারীরা।
সম্প্রতি ওই বৃদ্ধার বড় ছেলে রহমতুল্লা তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ফারিয়া ঘটনার সময়ে পাঁচ জনকে দেখতে পেয়েছিল। সেটা পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করেনি। উল্টে পুলিশ তাঁদের হেনাস্থা করেছে বলে তাঁর দাবি। পুলিশের অনুমান, বৃদ্ধার পরিবারের প্রত্যেকই পরিজনেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘প্রত্যক্ষদর্শী বারো বছরের কিশোরী হওয়ায় আমাদের তদন্তে অসুবিধে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের অসহায়তার কারণে আমারা তাকে ঠিক মতো জেরাও করতে পারছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy