গ্রেফতার হওয়া তিন যুবক। মহম্মদ সাইনুল, মহম্মদ তৌফির ও শাহ আলম।
অভিযোগ ওঠে বটে, অন্যের বিপদ দেখলে কলকাতা অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন, মুখ ঘুরিয়ে থাকে। কিন্তু বিপন্নকে সাহায্য করার ধর্ম থেকে কলকাতা এখনও পুরোপুরি ভ্রষ্ট হয়নি। রবিবার রাতে তারই সাক্ষী রইল পার্ক সার্কাসের কাছে মল্লিকবাজার তল্লাট।
খাস কলকাতা শহরের রাজপথে উদ্ভ্রান্ত, একা এক তরুণীকে পেয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তিন জন। শেষে তাদের মতলব টের পেয়ে তরুণী চিৎকার করে সাহায্য চান। বিপদ বুঝে স্থানীয় মানুষ ১০০ নম্বরে ডায়াল করলে পুলিশ পৌঁছে ওই তরুণীকে উদ্ধার করে, গ্রেফতার করা হয় তিন জনকে। ধৃতদের এক জন ওই ওয়ার্ড অফিসেরই নিরাপত্তারক্ষী। যতক্ষণ না পুলিশ সেখানে পৌঁছয়, ওই অফিস ঘিরে রেখে তিন জনকে আটকে রেখেছিলেন এলাকার মানুষ।
রবিবার, ছুটির দিনে ওয়ার্ড অফিসের ঘর কেন খোলা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এখন জানতে পারছি, দিনের শেষে কর্মীরা চলে যাওয়ার পরেও পুরসভার বহু অফিস কেবল নিরাপত্তারক্ষীদের ভরসায় খুলে রাখা হয়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’ তাঁর সাফ বক্তব্য, কোনও অঘটন ঘটলে তার দায় নিতে হবে অফিসার, কাউন্সিলর ও বরো চেয়ারম্যানকে। মেয়র জানান, বেসরকারি সংস্থার দেওয়া ওই রক্ষীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। শো-কজ করা হয়েছে সংস্থার কর্তৃপক্ষকেও।
তবে যাঁর ওয়ার্ড অফিসে এই কাণ্ড, ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের সেই তৃণমূল কাউন্সিলর সুস্মিতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ওই বাড়িতে ওয়ার্ড অফিস ছাড়াও হেল্থ ও সোশ্যাল সেক্রেটারিয়েটের অফিস রয়েছে। আমার অফিসের চাবি আমি নিজের কাছেই রাখি।’’
সেই ওয়ার্ড অফিস।
পুলিশ জানায়, তপসিয়ার অবিনাশ চৌধুরী লেনের বাসিন্দা ওই তরুণীর সঙ্গে তাঁর বাড়ির লোকজনের গণ্ডগোল হয়েছিল। এর পরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ওই তরুণী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে দিনভর বিভিন্ন জায়গায় দিশাহীন ভাবে ঘুরে পৌঁছন শেক্সপিয়র সরণিতে। রাতে তাঁর মনে হয়, এ বার বাড়ি ফেরা উচিত। কিন্তু তখন তিনি রাস্তা গুলিয়ে ফেলেন।
নিজে নিজে বাড়ি ফেরার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে আরও বেশি করে গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছেন দেখে ওই তরুণী পুলিশের সাহায্য চান। এ জে সি বসু রোড ও শেক্সপিয়র সরণির মোড়ে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ি দেখে তিনি তাঁদের কাছে পার্ক সার্কাসের রাস্তা জানতে চান। পুলিশকর্মীরা দেখিয়ে দিলে তিনি এ জে সি বসু রোড ধরে হাঁটতে শুরু করেন।
কিন্তু তরুণীকে তার আগে থেকেই অনুসরণ করছিল শাহ আলম ও তার বন্ধু মহম্মদ সাইনুল। পুলিশের গাড়ি ছাড়িয়ে ওই তরুণী যখন বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছেন, তখন ওই দু’জন তাঁর কাছে গিয়ে বলে, ‘‘এত রাতে আপনি রাস্তায় কী করছেন?’’ তারা আশ্বাসও দেয়, ‘‘কোনও চিন্তা নেই, আমরা আপনাকে বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি। আমরাই আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব।’’
এ কথা বলে তারা প্রথমে ওই তরুণীকে নিয়ে যায় ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের অফিসে। ওই অফিসে তরুণীকে নিয়ে তাদের ঢুকতে সাহায্য করে নিরাপত্তারক্ষী মহম্মদ তৌফির। সে সাইনুল ও শাহ আলমের পূর্ব পরিচিত। ওয়ার্ড অফিসে ওই তরুণীকে রুটি-মাংস খেতে দেওয়া হয়। পুলিশের বক্তব্য, সারা দিন কার্যত অভুক্ত অবস্থায় থাকা ওই তরুণী খাবার খেয়েও নেন।
এর পরে তরুণীকে ঠান্ডা পানীয় দেয় তারা। কিন্তু তরুণী তাতে সন্দেহজনক গন্ধ পাওয়ায় তা খেতে চাননি। ততক্ষণে তরুণী বুঝে গিয়েছেন, ওই তিন জনের মতলব ভাল নয়। তিনি দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে প্রাণপণে চিৎকার করে ওঠেন। তখন ওই তিন জন তাঁকে জাপটে ধরতে যায়। ফের আর্তনাদ করেন তরুণী। তখন তিনি দৌড়ে আর একটি ঘরে ঢুকে দ্রুত ছিটকিনি তুলে দেন।
ইতিমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ চিৎকার শুনে বুঝতে পারেন, কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। এক জন ডায়াল করেন ১০০ নম্বরে। ঘটনাস্থলে প্রথম পৌঁছয় পার্ক স্ট্রিট থানার একটি টহলদার গাড়ি। ওই তল্লাট যে থানার অন্তর্গত, সেই শেক্সপিয়র সরণি থানার পুলিশও তার পরে পৌঁছয়। বাসিন্দাদের অনেকেই তখন ওই ওয়ার্ড অফিসে ঢুকে যান, যাতে দুষ্কৃতীরা পালাতে না পারে।
পুলিশ জানায়, শাহ আলম বেনিয়াপুকুর, সাইনুল একবালপুর ও মহম্মদ তৌফির নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা। তিন জনের বিরুদ্ধেই অপহরণ ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা রুজু করেছে পুলিশ।
— নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy