যেন বলিউডি ছবির দৃশ্য!
নিরাপদ দূরত্বে থেকে এক ব্যক্তিকে অনুসরণ করছেন ভদ্রস্থ চেহারার একদল লোক। শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। স্টেশনে এসে ওই ব্যক্তি হাওড়াগামী একটি ট্রেনে উঠলে অনুসরণকারীরাও নিঃশব্দে উঠে পড়লেন ট্রেনে। তাঁরা গিয়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে বসে পড়লেন একই কামরায়। ট্রেন ছাড়ার কিছু পরেই অন্য যাত্রীরা দেখলেন অনেকটা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার মতো হঠাৎ নিজেদের শুল্ক দফতরের আর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা অফিসার পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিকে ঘিরে ধরল সাত জনের দলটি। শুরু হল তল্লাশি। ওই ব্যক্তির ব্যাগ হাতড়ে উদ্ধার হল পাঁচ-পাঁচটি সোনার বাট। এক কেজি করে ওজনের ওই বাটগুলির বাজার দর প্রায় দেড় কোটি টাকা! কাগজপত্র না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হল সমস্ত সোনা। গ্রেফতার করা হল ওই ব্যক্তিকে।
যাত্রীরা তখনও জানতে পারেননি শুল্ক অফিসার সেজে ওই দলটির সোনা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা আসলে পুরোটাই নাটক। তা টের পাননি আসলে সোনা পাচারের ‘ক্যারিয়ার’ শিলিগুড়ি থেকে আসা ওই ব্যক্তিও। তবে ‘ক্লাইম্যাক্সের’ অবতারণা হল ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছানোর পরে। ধৃত ব্যক্তিকে নিয়ে ওই দলটি হাওড়া স্টেশনের বাইরে আসার পরে এ বার তাঁদের ঘিরে ধরলেন দশ-বারো জনের আর একটি সশস্ত্র বাহিনী। তবে এ বারের ঘটনা আর সাজানো নয়। তল্লাশি চালিয়ে আসল গোয়েন্দাবাহিনীর অফিসারেরা উদ্ধার করলেন পাঁচটি সোনার বাট। সোনা পাচারের অভিযোগে সাত জনের ওই দল এবং শিলিগুড়ির বাসিন্দা ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দারা।
শুক্রবার সাত সকালে হাওড়া-দিঘা বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন জিআর রোড থেকে ধরা হয় ওই আট জনকে। পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন সকালে কামরূপ এক্সপ্রেসে শিলিগুড়ি থেকে হাওড়া আসেন তারা। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন শুল্ক দফতরের প্রাক্তন দুই সুপারিনটেন্ডেন্ট অনুতোষ খাসনবীশ ও অরবিন্দ দাস এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের অফিসার অতনুবিকাশ কাঞ্জিলাল। পুলিশ জানায়, কলকাতার বাসিন্দা এই তিন জনই দলের মাথা। সম্ভবত বিমানবন্দরে কাজ করার সময়ে পরিচয় হয় তাঁদের। সেই থেকেই একটি চক্র গজিয়ে ওঠে। যাঁরা এ ভাবেই কখনও পুলিশ, কখনও বা শুল্ক অফিসার পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিতেন সোনা। এ বার অবশ্য তাঁরা যাঁর থেকে সোনা হাতানোর ছক কষেন, শিলিগুড়ির ওই বাসিন্দা নিজেই সোনা পাচারকারী।
পুলিশ জানায়, এই তিন জন ছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে অনিল মজুমদার, মিলন রায়, আনন্দ ঘোষ, সঞ্জীবকুমার মাহাতো এবং বিজয় তামাঙ্গ নামে শিলিগুড়ির গুরুঙ্গ বস্তির ওই বাসিন্দাকে। বিজয়ই ‘ক্যারিয়ার’ হিসাবে ওই সোনা নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কামরূপ এক্সপ্রেসে ওঠেন। তাঁকে অনুসরণ করেই সাত জনের দলটি ট্রেনে উঠে নিজেদের শুল্ক দফতর ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরের অফিসার পরিচয় দিয়ে সোনা হাতিয়ে নেয় ওই যুবকের থেকে। পুলিশ জানায়, ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে এ দিন আদালতে পেশ করা হয়।
কিন্তু কী ভাবে ধরা হল চক্রটিকে?
হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ জানান, এক মাস আগে খবর আসে পুলিশ পরিচয় দিয়ে একটি দল হাওড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে কলকাতায় ধরে নিয়ে আসে মেদিনীপুরের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে। বড়বাজার থেকে কেনা সোনা ছিল ওই ব্যবসায়ীর কাছে। ধর্মতলায় এসে ওই দলটি তাঁর কাছ থেকে সোনা কেড়ে নেয় বলে পুলিশে অভিযোগ জানান ওই ব্যবসায়ী। এর পরেই তদন্তে নেমে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কিছু তথ্য আসে পুলিশের হাতে। তদন্তে তারা জানতে পারে এই দলটির কথা। এর পরেই পুলিশ বিশেষ সূত্রে খবর পায়, দলটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কামরূপ এক্সপ্রেসে উঠে এক সোনা পাচারকারীর থেকে সোনা হাতিয়ে হাওড়ায় আসছে। সেই মতো সাদা পোশাকে হাওড়া স্টেশনে হাড়ির ছিলেন গোয়েন্দারা। দলটিকে বমাল গ্রেফতার করেন তাঁরা।