Advertisement
E-Paper

ফাঁসাল তৃণমূল নেতারাই, বলছেন স্ত্রীও

কলিং বেল বাজতেই খুলে গেল কাঠের দরজাটা। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এল বিশাল এক সারমেয়। কিন্তু কে যেন তাকে ভিতরে টেনে নিল দ্রুত। বেরিয়ে এলেন সাদা প্রিন্টেড সালোয়ার-কামিজ পরা বছর চল্লিশের এক মহিলা। শনিবারের বারবেলা। ১৩-এ পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে কামিনী তিওয়ারি। তাঁর স্বামী বৃহস্পতিবার রাত থেকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপের ‘অতিথি’।

শিবাজী দে সরকার

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৫ ০৩:০৭

কলিং বেল বাজতেই খুলে গেল কাঠের দরজাটা। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এল বিশাল এক সারমেয়। কিন্তু কে যেন তাকে ভিতরে টেনে নিল দ্রুত। বেরিয়ে এলেন সাদা প্রিন্টেড সালোয়ার-কামিজ পরা বছর চল্লিশের এক মহিলা।

শনিবারের বারবেলা। ১৩-এ পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে কামিনী তিওয়ারি। তাঁর স্বামী বৃহস্পতিবার রাত থেকে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপের ‘অতিথি’। গিরিশ পার্ক কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত হিসেবে।

সাংবাদিকের কাছে কামিনীর অভিযোগ, তাঁর স্বামী গোপাল তিওয়ারিকে ফাঁসিয়েছেন শাসক দল তৃণমূলের কয়েক জন নেতা-ই। ক্ষুব্ধ কামিনীর কথায়, ‘‘আমার স্বামী তৃণমূলের হয়ে অনেক কাজ করেছে। কিন্তু ওই নেতারাই ওকে ফাঁসিয়ে দিল। বিপদের সময় কেউ এক বারও খোঁজ নিল না।’’ কারা সেই নেতা? কারা ফাঁসিয়েছেন আপনার স্বামীকে? নাম বলেননি কামিনী। সরাসরি উত্তর এড়িয়ে তাঁর জবাব, ‘‘শাসক দলের অনেক নেতার সঙ্গেই আমার স্বামীর সম্পর্ক ছিল।’’ পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে কামিনীর।

পরে, এ দিন বিকেলের দিকে লালবাজারে যান কামিনী। মিনিট পাঁচেক তাঁকে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, কামিনী তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘ক্যায়সে হো?’’ গোপাল কোনও উত্তর দেয়নি। গ্রেফতার হওয়ার আগে গোপালকে যখন পুলিশ গরুখোঁজা খুঁজছে, সেই সময়ে স্বামীকে তৃণমূলের এক জন কর্মী বলেই দাবি করেছিলেন কামিনী।

পুলিশ সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর গোয়েন্দা অফিসারদের কাছে ক্ষোভের সুরে গোপাল বলেছিল, ‘‘যাদের জন্য খাটলাম, তারাই বলির পাঁঠা করল! এখন কেউ নাকি আমাকে চিনতেই পারছে না!’’ এ দিন একই কথা শোনা গেল তার স্ত্রীর মুখেও।

তৃণমূল ও পুলিশ সূত্রের খবর, শাসক দলের মধ্য কলকাতার নেতা সঞ্জয় বক্সী এবং আর এক স্থানীয় তৃণমূল নেতা তপন রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল গোপালের। তৃণমূলের কয়েক জন নেতার নির্দেশেই গোপাল ও তার শাগরেদরা ১৮ এপ্রিল, শহরে পুরভোটের দিন মধ্য কলকাতার একাংশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। ভোট শেষের পর বিকেলে সিংহিবাগানে কংগ্রেস অফিসে হামলা চালায় তারা। গোলমাল থামাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সাব-ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল।

তৃণমূল সূত্রের খবর, গত বছর লোকসভা ভোটে বড়বাজার তল্লাটের অনেক ওয়ার্ডে শাসক দল পিছিয়ে ছিল। পেশীশক্তি ব্যবহার করে সেই হারানো জমি পুনরুদ্ধার করতেই গোপাল ও তার লোকেদের কাজে লাগাতে শুরু করেন দলের স্থানীয় নেতারা। পুলিশের দাবি, এসআই জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যখন চাউর হয়ে যায়, গোপালকে গিরিশ পার্ক কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত হিসেবে লালবাজার খুঁজছে, তার পর থেকেই নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেন তৃণমূল নেতারা। দলের শীর্ষ মহল থেকে তাঁদের কাছে নির্দেশ পৌঁছয়, কোনও অবস্থাতেই গোপালের পাশে থাকা চলবে না।

এক গোয়েন্দা অফিসার জানান, অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন শাসক দলের কয়েক জন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপাল বলেছিল, ‘‘আমি তো আপনাদের কথায় সব করলাম। আর এখন আমাকে বাঁচাবেন না?’’ নেতারা তাকে সাফ জানিয়ে দেন, পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি আর তাঁদের হাতে নেই। এক জন গোপালকে এ-ও বলেন, ‘‘শুধু ভোটের কাজ করতে বলা হয়েছিল। পুলিশের উপরে হামলা করার কী দরকার ছিল?’’ ওই নেতা বলে দেন, এর দায় গোপালকেই নিতে হবে।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, তার পরেও দু’দিন, ১৯ ও ২০ এপ্রিল কলকাতায় গোপন আস্তানায় কাটানোর সময় গোপালের আশা ছিল, শাসক দলের কোনও নেতা হয়তো শেষ পর্যন্ত তার পাশে দাঁড়াবেন। তার মনে হয়েছিল, এসআইয়ের উপরে গুলি চালানো ইফতিকার-কে ধরিয়ে দেওয়া এবং তার অস্ত্রটি উদ্ধারে সে-ই যখন পুলিশকে সাহায্য করেছে, তখন সে নিজে অন্তত রেহাই পাবে। কিন্তু তা হচ্ছে না বুঝে গোপাল কলকাতা ছাড়ে ২১ এপ্রিল।

গিরিশ পার্ক কাণ্ডের তদন্তের সূত্রেই গোপালের সঙ্গে তৃণমূলের কয়েক জন স্থানীয় নেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় সেই ছবি, যেখানে একই মঞ্চে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা, দুই তৃণমূল নেতা সঞ্জয় বক্সী ও তপন রায়ের সঙ্গে হাজির ছিল গোপাল। শাসক দলের একাংশের মতে, গোপালের স্ত্রী কামিনী তৃণমূলের কোনও নেতার নাম না জানালেও তাঁর অভিযোগের তির আসলে সঞ্জয়বাবু ও তপনবাবুর দিকেই।

কামিনীর অভিযোগ সম্পর্কে সঞ্জয় বক্সীর প্রতিক্রিয়া জানতে গিরিশ পার্ক এলাকার বলরাম দে স্ট্রিটে তাঁর বাড়িতে গেলেও ওই নেতার দেখা মেলেনি। তাঁকে ফোন এবং এসএমএস করা হয়। কোনও উত্তর পাওয়া য়ায়নি। তবে বাড়িতে বসে সঞ্জয়বাবুর স্ত্রী তথা তৃণমূল বিধায়ক স্মিতা বক্সী দাবি করেন, ‘‘আমি গোপাল তিওয়ারি নামে কাউকে চিনি না। আমার স্বামীর সঙ্গে গোপাল তিওয়ারির ছবি তৈরি করে আপনারা মিথ্যা প্রচার করছেন।’’ তৃণমূল নেতা তপন রায়েরও দেখা মেলেনি তাঁর বিন্দু পালিত লেনের বাড়িতে। মোবাইলও ছিল বন্ধ।

গোপালের সঙ্গে একই মঞ্চে তাঁর উপস্থিতির ছবি কাগজে প্রকাশিত হওয়ার দিন মন্ত্রী শশীদেবী বলেছিলেন, ‘‘মঞ্চে আমার পিছনে কে, কখন উঠছে, কী ভাবে জানব!’’ সঞ্জয় বক্সীরও বক্তব্য ছিল, ‘‘মঞ্চে আমরা সামনের দিকে থাকি। পিছন থেকে কে উঠে পড়ছে, সেটা কী ভাবে বুঝব!’’ গোপাল ও তার শাগরেদদের সঙ্গে পরিচিতির কথা বরাবরই অস্বীকার করেছেন সঞ্জয়বাবু। যদিও গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ভোটের আগে গোপাল তার শাগরেদদের নিয়ে নিজের বাড়িতেই বৈঠক করেছিল। সেখানে তখন হাজির ছিলেন এক তৃণমূল নেতাও। ‘কাজের’ ছক কষা হয়েছিল ওই বৈঠকে। ভোটের দিনে গিরিশ পার্কে কংগ্রেস অফিসকে কেন্দ্র করে যে ঝামেলা করা হবে, ওই বৈঠকেই তা ঠিক হয়েছিল বলে খবর।

কামিনী এ দিন তৃণমূল নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোয় প্রশ্ন উঠেছে, গোপাল ও তার দলবলকে যাঁরা কাজে লাগিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, ‘তদন্তের স্বার্থে’ পুলিশ কি এ বার তাঁদের নিয়ে টানাটানি শুরু করবে?

লালবাজারের এক সূত্র অবশ্য জানিয়ে দিচ্ছেন, সেই বৈঠক অথবা কামিনীর অভিযোগ— গিরিশ পার্ক কাণ্ডের তদন্তে এ সব নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘এই ঘটনায় গোপালই চূড়ান্ত সীমা। তার পরে আর এগোনো হবে না। আপাতত এটাই ঠিক আছে।’’ এবং সম্ভবত সেই কারণেই গোপালের মদতদাতাদের গ্রেফতার করা হবে কি না, প্রশ্ন তুলতেই লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার মন্তব্য, ‘‘ওটা আমাদের তদন্তের বিষয় নয়।’’ যে প্রসঙ্গে বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, শাসক দলের নেতাদের হাত মাথায় থাকলে গোপালকে গ্রেফতার করাটাই অসম্ভব ছিল। তাঁরা হাত তুলে নেওয়ায় গোপালকে ধরা গিয়েছে, এটাই অনেক। পুলিশ প্রশাসন যে কেঁচো খুঁড়ে সাপ বের করতে যাবে না, সেটা সহজবোধ্য।

গোপালের পরিবারের তরফে আদালতে আবেদন জানানো হয়েছিল, গরমের কারণে তার জন্য বাড়ির হাল্কা খাবার লালবাজারে পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। সরকারি আইনজীবী শুভেন্দু ঘোষ এ দিন জানান, আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে। ফলে গোপাল বাড়ির খাবার খেতে পারবে। শর্ত একটাই, গোয়েন্দাদের সামনে বাড়ির লোককে আগে ওই খাবার খেয়ে দেখাতে হবে।

shibaji dey sarkar Gopals arrest Trinamool girish park Tapan Ray
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy