Advertisement
E-Paper

জানি, তিনি বললে এক লাখ লোক রক্ত দেবে, তবুও...

সারা দিনে কত শত হোয়াটস্‌অ্যাপই তো আসে। অনেক কিছুর সঙ্গে সারা দুনিয়ার খবরও। আজ দুপুরে তেমনই একটা মেসেজ এসেছিল— গণেশ টকিজের কাছে ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে। প্রথমে খুব যে গুরুত্ব দিয়েছিলাম তেমন নয়!

রায়া দেবনাথ

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৬ ২৩:১১

সারা দিনে কত শত হোয়াটস্‌অ্যাপই তো আসে। অনেক কিছুর সঙ্গে সারা দুনিয়ার খবরও। আজ দুপুরে তেমনই একটা মেসেজ এসেছিল— গণেশ টকিজের কাছে ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে। প্রথমে খুব যে গুরুত্ব দিয়েছিলাম তেমন নয়! কিন্তু, পরের মুহূর্ত থেকে এক নাগাড়ে যে ভাবে মেসেজ এবং ছবি আসা শুরু হল, তাতে বুঝতে পারছিলাম ঘটনা কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে! আর ঠিক তখন থেকেই টিভিতে লাইভ দেখানো শুরু করল। আনএডিটেড! ভয়ানক! এতো আক্ষরিক অর্থেই মাথার উপর ‘আকাশ ভেঙে পড়া’!

লোহার বিম আর সিমেন্টের ঠাসা চাঙড়ের মধ্যে কি আছে, কারা আছেন, তার থেকেও তখন বেশি মনে হচ্ছিল আহত-অসহায় অবস্থায় তখনও উদ্ধার হওয়া প্রাণগুলোর কথা! যে ভাবে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আর হাসপাতালের যা ছবি দেখছিলাম, তাতে বুঝতে পারছিলাম, প্রচুর রক্ত লাগবে। গরমকালে এমনিতে রক্তের হাহাকার থাকে। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার-নার্স বন্ধুদের ফোন করি। রক্ত দিতে চাই। ওরা আমাকে বলল, ‘হিউজ প্রেসার, এখানে রক্ত দেওয়ার কোনও পরিস্থিতি নেই। তুই বরং সেন্ট্রাল ব্লাডব্যাঙ্কে যোগাযোগ কর।’

তত ক্ষণে অন্য বন্ধুদের ফোনও পেতে শুরু করেছি। ওঁরাও রক্ত দিতে চায়। একটা ‘ডেটা’ তৈরি হয়ে গেল মুহূর্তে— রক্ত দিতে চাওয়া বন্ধুদের তালিকা ও মোবাইল নম্বর। সেটা ডাক্তার বন্ধুদের পাঠিয়ে দিয়ে বলা হল, লাগলে এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিস। এর কিছু ক্ষণ পরেই ফেসবুকে একটা লেখা দেখলাম। মানিকতলা সেন্ট্রাল ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তদানের আহ্বান। আয়োজক মূলত ডিওয়াইএফআই এবং এসএফআই। এমন একটা সময়ে রাজনৈতিক খুঁতখুঁতানি থাকার কোনও মানেই হয় না। কারা আয়োজক সেটা দেখে লাভ কি! দু’এক জন বন্ধুকে ফোনে জানিয়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে। তখন বিকেল পাঁচটা।

চাঁদনিচক থেকে মানিকতলা পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। ব্লাডব্যাঙ্কের বাইরে দেখলাম, আয়োজকদের বেশ কিছু পতাকা রয়েছে। প্রচুর ভিড়। লাইনটা বাইরে চলে এসেছে। দাঁড়ালাম সেই লাইনের পেছনেই। ফেসবুকের ওই প্রচারে অজস্র মানুষ এসেছেন। অনেকেরই পরিচয় অরাজনৈতিক। তাঁদের অনেককে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। কয়েক জন বন্ধুকেও পেয়ে গেলাম। লাইনে নিজের জায়গাটা রেখে ভেতরে কেমন কাজ চলছে সেটা দেখতে গিয়েই ব্যানারটা নজরে এল। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জন আপত্তিও করছেন ডিওয়াইএফআই-এর ওই ব্যানারটা নিয়ে। আমিও মুখ খুললাম। এমন একটা কাজে কোনও রাজনৈতিক ব্যানার ব্লাডব্যাঙ্কের ভেতরে লাগানোর কী প্রয়োজন! চেঁচানোর চোটে তা খুলেও ফেলা হল মুহূর্তে।

আর তখনই হন্তদন্ত হয়ে সপারিষদ সেখানে ঢুকলেন নির্মল মাজি। ঢুকেই হম্বিতম্বি! সংবাদমাধ্যমে কাজের সুবাদে এই ভদ্রলোককে চিনি। পরিবর্তনের সরকার গঠনের পর থেকে বকলমে স্বাস্থ্য দফতর নির্মলবাবুর হাতের মুঠোতেই ছিল। এখনও যে রাশ হাল্কা হয়নি, সেটা টের পেলাম তাঁর ধমকানিতে, ‘বাইরের পতাকা কে লাগিয়েছে? খুলে ফেলতে হবে।’ আয়োজকদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করলেন, ‘ভেতরেরটা তো খুলে ফেলেছি। বাইরেরগুলো কেন খুলব?’ তার পরেই মোক্ষম বাক্যটি ছুড়লেন নির্মলবাবু, ‘বাইরের ব্যানার খুলে না নিলে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প বন্ধ করে দেব।’ বন্ধ করে দেবেন! এত কষ্ট করে মানুষগুলো এসেছেন, কিছু মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে! আর উনি বন্ধ করে দেবেন! শুরু হল চিত্কার চেঁচামেচি। লাইনটা প্রায় তেড়েফুঁড়ে উঠল। পরিস্থিতি বেগতিক ঠেকল! সেটা বোধহয় টের পেলেন নির্মলবাবু। সামলাতে গিয়ে যেটা বললেন, সেটা আরও মারাত্মক! ‘না, না, ব্লাড ব্যাঙ্কের আর ক্যাপাসিটি নেই।’

সেন্ট্রাল ব্লাডব্যাঙ্কের আর ক্যাপাসিটি নেই! প্রশ্নগুলো উঠতে শুরু করতেই নির্মলবাবু ঘটনাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এক ঘণ্টার মধ্যে আয়োজকদের আবেদন মেনে যে ভাবে ওই ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা এই ক্যাম্প চালু করেছেন, তা অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু, নির্মলবাবুর কথার কোনও প্রভাব পড়ল না বোধহয় তখনই। এই ঘটনা যখন ঘটছে তখন ঘড়িতে ৬টা বাজে। সেই লাইন পেরিয়ে যত্নশীল ব্যাঙ্ককর্মী যখন আমার রক্ত নিলেন তখন রাত আটটা। তা হলে নির্মলবাবু কি ভাঁওতা দিয়ে গেলেন, ‘না না ব্লাড ব্যাঙ্কের আর ক্যাপাসিটি নেই।’

বাসে করে বাড়ি ফেরার পথে শুনলাম, বন্ধুরা জানাল, আজকের মতো রক্ত নেওয়া বন্ধ হয়েছে। লাইনে দাঁড়ানোদের ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কাল সকাল থেকে আবার শুরু হবে। ব্যাঙ্ক চত্বরে পুলিশ পৌঁছেছে। কিন্তু, অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। যখন বাসের মধ্যেই এক সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুর গ্রুপ হোয়াটস্‌অ্যাপটা পেলাম। পড়তে শুরু করলাম। ঝাপসা চোখে মেসেজ পড়া শেষও করলাম। কী লেখা ছিল সেই মেসেজে? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কেউ কেউ এটা নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে। আমি বলব, না করতে। আমাদের ব্লাড এনাফ আছে। ব্লাড দেওয়ার হুজ্জুতি করার প্রয়োজন নেই। ব্লাডের প্রয়োজন থাকলে, সবাই আছেন, আমি বললে এক লাখ লোক ব্লাড দেবে।

সাবাশ বলে নিজের পিঠটা চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল। বুঝলাম, নির্মলবাবুর আসার আসল উদ্দেশ্য। তবে এটা বুঝতে পারলাম না, রক্ত দিয়ে কোন নোংরামিটা করলাম?

blood donation camp vivekananda flyover collapse vivekananda flyover raya debnath nirmal maji
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy