Advertisement
E-Paper

লেপ ছেড়ে শীত উড়িয়ে কৃচ্ছ্রসাধন

ফজরের নমাজেরও এক ঘণ্টা আগে ভোর চারটে থেকে শুরু হয় এই কর্মকাণ্ড। শহর কলকাতায় জিরেন দেওয়া টাটকা খেজুর রস হাত বাড়ালেই মিলবে না।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৫২
নিহারির টানে ভিড়। বুধবার ভোরে জাকারিয়া স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র।

নিহারির টানে ভিড়। বুধবার ভোরে জাকারিয়া স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র।

বঙ্গভঙ্গ রুখতে কাছেই চিৎপুরের মসজিদে রাখি বাঁধার ডাক দিয়ে হাজির হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

এই শীতে ভোরের আলো ফোটারও ঢের আগে আর এক মহাসম্মেলনে জেগে ওঠে সেই তল্লাট। নাখোদা মসজিদের ফটকের উল্টো দিকে তামার বিশাল হাঁড়ি বা ‘সাহাব ডেগ’ ঘিরে আশ্চর্য জমায়েত। লাল টকটকে ঝোলের হাঁড়ির পাশে থালায় সাজানো পুরুষ্টু মাংসখণ্ড। অপেক্ষায় হুডওয়ালা রোমশ জ্যাকেট থেকে বাঙালির প্রিয় ‘মাঙ্কি ক্যাপ’। জাকারিয়া স্ট্রিটের ফুটপাথে সারিবদ্ধ অবরোধকারীর মতো গাদাখানেক টিফিন ক্যারিয়ার। কুপনের বিনিময়ে রেখে যাওয়া স্টিলের বাসন আগের রাত থেকেই অবস্থান করছে ওই চত্বরে।

ফজরের নমাজেরও এক ঘণ্টা আগে ভোর চারটে থেকে শুরু হয় এই কর্মকাণ্ড। শহর কলকাতায় জিরেন দেওয়া টাটকা খেজুর রস হাত বাড়ালেই মিলবে না। তবে শীতের আর এক সুখ নিহারি মজুত এখনও। নাইট শিফ্‌ট সেরে সদলে আসেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা। কসবার রুবি পার্কের ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত ফি শীতে অন্তত বার পাঁচেক আসেন ‘নিষিদ্ধ মাংসের’ টানে। ভোর পাঁচটাতেও বসার জায়গা পেতে সপরিবার মিনিট কুড়ি ঠায় দাঁড়াতে হবে।

সাড়ে ছ’টা-সাতটার মধ্যে হাঁড়িতে শুধুই তলানি। আরবি ‘নাহার’ বা ভোর শব্দটিতেই উৎস নিহারির। মাঝ নভেম্বর থেকে বড়জোর মাঝ ফেব্রুয়ারি অবধি মেয়াদ এই ধোঁয়া ওঠা ঝোল-মাংসের। সঙ্গতে তন্দুরি রুটি বা ডালপুরি। কম করে ৭-৮ ঘণ্টা ফুটিয়ে তৈরি মাখন-নরম গোমাংসের সুরুয়া খেলেই শীত উধাও। শীতের কামড় কড়া না হাল্কা থোড়াই কেয়ার! জাকারিয়া স্ট্রিটের ভিড় হাল্কা হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই।

কলকাতার বিরিয়ানির মক্কা যদি সিরাজ-আরসালান হয়, তবে শীতের প্রভাতী নিহারির মহাতীর্থ জাকারিয়া স্ট্রিটের সুফিয়া। কাছেই কলুটোলায় ইসলামিয়া-য় বসার জায়গা মেলা সহজ। তাদের কর্তা কাম মাস্টার শেফ জুবের জমান হাল্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘‘আমাদের নিহারিও কম যায় না, তবে মসজিদের উল্টো দিকের ‘লোকেশন’-এর জন্যই সুফিয়ায় বেশি ভিড়।’’ এমনিতে ৩৬৫ দিনই শহরের মুসলিম পাড়ায় মাটন বা বিফের নানা কিসিমের প্রাতঃরাশ চালু আছে, তবে তার সঙ্গে নিহারির শীত-বিলাসের আকাশ-পাতাল ফারাক। এ ঠিক ব্যস্ত দিনের কেজো জলখাবার নয়। বরং ভোজের জন্য ভোজের টানটাই বড় কথা। কনকনে শীত-সকালের লেপমুড়ি আরাম পর্যন্ত যার কাছে তুচ্ছ।

মাটন অনুরাগীদের জন্য মল্লিকবাজার-রিপন স্ট্রিট-খিদিরপুরের সকালে পায়া-র দেখাও মেলে। তবে তাতে মাংস কম। কয়েক ঘণ্টা ধরে ফুটনো স্বাদু হাড়ের নির্যাস আখের রসের মতো চুষে ফেলতে হবে। মল্লিকবাজারের সিরাজ বা খিদিরপুরের ইন্ডিয়া হোটেলে গোমাংসের প্রবেশ নিষেধ। তারা মাটনের জুবান (জিভ), মগজ, কিমা, মেটে, ডালগোস্তের উপচার সাজায়। নামজাদা মোগলাই হোটেলের মধ্যে মাটন নিহারি সম্ভবত ইন্ডিয়া হোটেল বা চিনার পার্কের আমিনিয়াই করে। তবে সেটা সন্ধ্যার পরে। যে বেচারিরা সকালে উঠতে পারেন না, তাঁদের জন্য ‘সান্ত্বনা-পুরস্কার’!

এখন বন্ধ, তবে জাকারিয়ার আমিনিয়াও একদা সান্ধ্য নিহারি করত। সুফিয়া, আমিনিয়া, ইসলামিয়ার কর্তারা সক্কলেই লখনউয়ের কাছে দরিয়াবাদের ভূমিপুত্র। নিহারিতে না কি চন্দনের গুঁড়োও মেশে! এই সে-দিনও গোপন তুকতাক ফাঁস করবেন না বলে নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে মশলা কিনতেন আমিনিয়ার নাভেদ আমিন। ইসলামিয়ার জুবের ভাইও নিহারির মশলার রহস্য নিজের বউকে অবধি বলবেন না। রং-গন্ধ-উষ্ণতার জন্য আলাদা আলাদা জড়িবুটি। দুর্লভ কালেজি বোটি বা পায়ের কাছের তুলতুলে মাংসের টানেই রসিকজন মুখিয়ে থাকেন।

গুষ্টিসুখ ছাড়া এ খানা ঠিক জমে না যেন। মেয়েরা এখনও সংখ্যালঘু এ সব ঠেকে। তবে বালিগঞ্জের দেবারতি বিশ্বাস, মহম্মদ সালিম, পাটুলির অরিন্দম পাল, শ্রাবণী পালদের দেখা গেল প্রকাণ্ড বাটিতে ভাগ করে মুজতবা আলি কথিত কাবুলি কায়দায় পিত্তরক্ষা করছেন। অনেকেই তিন-চার ‘জ্যারিকেন’ রসদ ভরে নেন। কয়েক দিন ধরে বাসি খেলে স্বাদ আরও খুলবে।

তবে এর জন্য চাই কৃচ্ছ্রসাধন। শেষ রাতে শুধু যোগী নয়, রসিক ভোগীরাও নিহারির টানে আলসেমি ঝেড়ে উঠে পড়েন।

Jakaria street Meat Food Winter জাকারিয়া স্ট্রিট খাদ্য শীত
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy