Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
মমতার ধমক গায়েই মাখছে না পুলিশ

শাসকের ঘরের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হাওড়া, আতঙ্ক

কয়েক দিন আগেই হাওড়ায় গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া তো দূরস্থান, বরং তার পরেও রক্তস্নাত হল রাজপথ। এবং তা হল শাসক তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে। সবটাই পুলিশের চোখের সামনে। যাদের ভূমিকা ছিল নিছক দর্শকের।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা পুলিশের। সোমবার, রামরাজাতলায়। — নিজস্ব চিত্র।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা পুলিশের। সোমবার, রামরাজাতলায়। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা‌
হাওড়া শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

কয়েক দিন আগেই হাওড়ায় গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া তো দূরস্থান, বরং তার পরেও রক্তস্নাত হল রাজপথ। এবং তা হল শাসক তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে। সবটাই পুলিশের চোখের সামনে। যাদের ভূমিকা ছিল নিছক দর্শকের।

হাওড়া হোমস্ শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দু’টি গোষ্ঠীর গোলমাল চলছিল কয়েক দিন ধরেই। সোমবার তা চরমে ওঠে। মারপিট, ইট ছোড়াছুড়ি হয়। এক গোষ্ঠী আর এক গোষ্ঠীর সমর্থককে রাস্তায় ফেলে মারধর করে। এক জনের মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এই ঘটনার পরেই একদল যুবক মোটরবাইকে এসে পুলিশের সামনেই কলেজের গেট লক্ষ করে গুলি চালায় ও বোমা ছোড়ে। যদিও তাতে কেউ হতাহত হয়নি। পরে বিশাল পুলিশবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

হাওড়া হোমস্ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অঞ্জন টাকি। জেলার রাজনৈতিক মহলে যিনি তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ রায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। প্রশিক্ষণ শেষ করে ওই কলেজ ছাড়ার পরে তাঁকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি করা হয়। অপর দিকে হাওড়া হোমসে্র ছাত্র সংসদে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শেখ নিয়ামত আলি। তৃণমূলের গোষ্ঠী কলহে অরূপবাবুর বিরোধী শিবিরের নেতা তথা ডোমজুড়ের বিধায়ক ও রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত তিনি। ফলে হাওড়া হোমসে্র ভিতরে রাজনৈতিক খবরদারির লড়াইটা কার্যত এসে দাঁড়িয়েছিল একই জেলার তৃণমূলের দুই মন্ত্রীর মধ্যে।

যদিও দুই মন্ত্রীর কেউই এই গোষ্ঠী কলহের কথা মানতে চাননি। সেচমন্ত্রী রাজীববাবু বলেন, ‘‘আমি ওই কলেজের ব্যাপারে কিছু জানি না। কে, কোন স্বার্থে ঘনিষ্ঠ বলছে, সেটা দেখতে হবে। তবে শিক্ষাঙ্গনে এ সব হওয়া ঠিক নয়।’’

তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপবাবুর আবার বক্তব্য, ‘‘কেউ আলাদা করে আমার ঘনিষ্ঠ নন। তবে যা-ই হোক, পুলিশকে বলেছি, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে। দলও সব খতিয়ে দেখে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’’ মন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি হাওড়ার পুলিশ কমিশনারকে বলেছেন, অঞ্জন টাকি-সহ কোনও বহিরাগতকেই যেন কলেজে ঢুকতে দেওয়া না হয়।

ওই কলেজ সূত্রে খবর, অঞ্জন প্রাক্তন ছাত্র হলেও দলবল নিয়ে কলেজে প্রায়ই আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতেন। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নিয়ামতের অভিযোগ, ‘‘অঞ্জনদা কলেজের সব বিষয়ে নাক গলাতেন। তিনি প্রায় প্রতিদিন বহিরাগতদের সঙ্গে এনে পড়ুয়াদের নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করতেন। প্রতিবাদ করলে মারধরও করতেন।’’

নিয়ামতের দাবি, গত কয়েক মাস ধরে বহিরাগতদের নানা অত্যাচার সহ্য করার পরে শুক্রবার তিনি এবং বাকি পড়ুয়ারা এই সব ঘটনার প্রতিবাদ করেন। তাঁর অভিযোগ, এর জেরেই অঞ্জন এবং তাঁর সঙ্গে আসা বহিরাগতেরা গোলমাল শুরু করেন। ছাত্রীদের সঙ্গেও অশালীন আচরণ করা হয়। পুলিশ জানায়, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে সে দিন মারপিটও হয়। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডাকলে পরিস্থিতি তখনকার মতো নিয়ন্ত্রণে আসে। ফের গোলমালের আশঙ্কায় কলেজ চত্বরে পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে।

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঞ্জন অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমি ওই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি। তাই কলেজে যেতাম। আমার বিরুদ্ধে ওঠা এ সব অভিযোগ মিথ্যা। ওঁরাই বহিরাগতদের ডেকে কলেজে গোলমাল পাকাচ্ছেন।’’

পুলিশ জানায়, শুক্রবারের পরে সোমবার বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ ফের দলবল নিয়ে কলেজে পৌঁছন অঞ্জন। তিনি আসতেই আবার উত্তেজনা ছড়ায়। বহিরাগতদের নিয়ে কলেজে ঢোকার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন তাঁরই দলের ছাত্র সংসদের দায়িত্বে থাকা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। এ নিয়ে কলেজের সামনের গেটে পুলিশের সামনেই দু’পক্ষের মধ্যে প্রবল হাতাহাতি বেধে যায়।

এর পরে পুলিশ দু’পক্ষকে দু’দিকে সরিয়ে দিলে পরস্পরের বিরুদ্ধে ইট ছুড়তে শুরু করে। এর কিছুক্ষণ পরেই কলেজের পিছনের গেটে পুলিশের সামনেই দু’রাউন্ড গুলি চালায় মোটরবাইকে করে আসা এক যুবক। পরপর তিনটি বোমাও ছোড়ে। কিন্তু বোমাগুলি পুকুরে পড়ায় আর ফাটেনি। এর পরেই বিশাল পুলিশবাহিনী কলেজ চত্বরে ছুটে এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ঘটনার প্রতিবাদে পড়ুয়ারা জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতির কুশপুতুল দাহ করে বিক্ষোভ দেখান।

কলেজের ডেপুটি ডিরেক্টর (ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং) সিদ্ধার্থ বসু বলেন, ‘‘কলেজে বহিরাগত ঢোকে বলে জানি না। তবে গত দেড় বছরে এমন ঘটনা ঘটেনি। পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে সমস্যা মেটাতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE