Advertisement
০৫ অক্টোবর ২০২৪
Trolling

Internet Trolling: নিত্যনতুন ছিন্ন মুণ্ডের সন্ধান মিলছে সমাজমাধ্যমে…

সমাজমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে, অনেকের এটাই এখন অবকাশযাপন। ভোটের আগে নেট পরিসরের এই ‘নরমুণ্ড’ অভিযানে রাজনৈতিক তাগিদ ছিল।

প্রতীকী ছবি।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২২ ০৬:২৪
Share: Save:

কারও ভাতপাতে আচার না হলে চলে না! কারও জলজ্যান্ত খোরাক। নিছকই পাঁঠা বা মুরগি নয়, কিন্তু পাঁঠা বা মুরগির মতোই তাকে কেটে ছিন্নভিন্ন করা যাবে, ছিন্ন দেহকেও ফের কেটেকুটে অন্তহীন ভোজ উপভোগ করা যাবে তারিয়ে তারিয়ে।

সমাজমাধ্যমের দিকে তাকিয়ে মনে হতে পারে, অনেকের এটাই এখন অবকাশযাপন। ভোটের আগে নেট পরিসরের এই ‘নরমুণ্ড’ অভিযানে রাজনৈতিক তাগিদ ছিল। প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করতে সজাগ ছিল সংগঠিত রাজনৈতিক লেঠেল-বাহিনী। এখন সংঘাত অত বাছবিচারের ধার ধারে না। কে কার বন্ধু, তা-ও অনেক সময়ে অবান্তর! হুল ফোটানোর আমোদে তাই খুচখাচ সেমসাইডও চলবে। রোজ সকালে নতুন এক জন ভিলেনের খোঁজে নেমে পড়ে বেছে নিই, আজ অমুক লেখকের বিতর্কিত বিবৃতি না তমুক সঙ্গীতশিল্পীর বেফাঁস লাইভ ভিডিয়োকে বেছে নেওয়া হবে! যিনি যত বিখ্যাত, তাঁর দুর্ভোগ তত বেশি। শুধু ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করেও সুখ নেই। তাঁর পরিবার, স্ত্রী, সন্তান, মা, প্রেমিক— তাঁদেরও রক্তাক্ত না-করে শান্তি কই!

কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসে জনপ্রিয় বলিউডি গায়ক কেকে-র আকস্মিক মৃত্যু এবং তার ঠিক আগে স্থানীয় সঙ্গীতশিল্পীদের প্রতি অবহেলা নিয়ে গায়ক রূপঙ্করের ‘অভব্য’ লাইভ ভিডিয়োর অভিঘাতে সম্প্রতি নতুন প্রাণ পেয়েছিল ট্রোল-সংস্কৃতি। ওই গায়ক লিখিত ভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। বাজার হারানোর ভয়ে তাঁর গাওয়া জিঙ্গল সরিয়ে দিয়েছে জনপ্রিয় কেক সংস্থা। তাতেও উত্তেজনায় সহজে প্রলেপ পড়েনি। অনেকেই মনে করেন, নামী-অনামী অনেকেরই আপত্তিজনক আচরণ দেখা যায়। কিন্তু যে ভাষায় তাঁকে এলোপাথাড়ি আক্রমণ করা হয়ে থাকে, সেটাও সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা মৈত্রেয়ী চৌধুরী বলছেন, “এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বার বার এ ভাবেই ব্যক্তিবিশেষ, মহিলা হলে আরওবেশি করে কোণঠাসা করাই নেট-সংস্কৃতি। আগে লোকে যা মুখে আনতে লজ্জা পেত, তা-ও দেখছি হ্যাশট্যাগ হয়ে যাচ্ছে।”

দেখা যাচ্ছে, সদ্য মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ কৃতী ছাত্রছাত্রীরা কে কত ক্ষণ পড়ত বা কেউ সত্যিই কতটা মেধাবী, এ সব নিয়েও ছুরি উঁচিয়ে নেট-সমালোচকেরা। ছোটরাও ছাড় পাচ্ছে না। পরীক্ষা-পদ্ধতির সমালোচনা ছাপিয়ে পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত আক্রমণও করা হচ্ছে। অন্য একটি মত বলছে, সমাজমাধ্যমে মজা করে বলা আলগা মন্তব্যও রাজনৈতিক শুদ্ধতার মাপকাঠিতে পাশ না-করলে বিস্ফোরক হতে পারে। মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলছিলেন, “এক দিকে নিজেকে সহজে প্রকাশের ইচ্ছে রয়েছে। আবার পদে পদে কী বললাম, কী পরলাম, কী খেলাম নিয়ে আশঙ্কা, পাছে লোকে কিছু বলে।” মোহিতের কথায়, “বাস্তবে যাবতীয় হিংসা, ঘেন্নার সম্প্রসারণ হয়ে উঠেছে সমাজমাধ্যম। খুনোখুনি, রক্তপাত সমাজজীবনে কমছে না, নেট-পরিসরেও তা প্রবল।”

ফেসবুকে নানা আলোচনায় সক্রিয় থাকেন সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও বলছেন, “আমার কিছু কথা নিয়েও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিজের লেখা নিয়ে যা শুনতে হয়েছে, তাতেও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়েছি।” সঙ্গীতার উপন্যাসে নানা সময়ে যৌনতার বর্ণনা এসেছে। তাঁর একটি উপন্যাসের নাম ‘প্যান্টি’। ট্রোল-সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে সঙ্গীতার কথায়, “দেড় দশক আগেও আমার লেখা বা উপন্যাসের নাম নিয়ে সমালোচনা হত। লোকে ফোনে উল্টোপাল্টা বললে তাঁদের বোঝানো সহজ ছিল। কিন্তু ফেসবুকে যে কোনও বিতর্কে আমার লেখা টেনে যে কটূক্তি চলে, তাতে অনেক বিষয়ে লিখতে জড়তা হয়। যৌনতার রাজনীতি নিয়ে আগে যত সহজে লিখতে পারতাম, এখন পারি না!”

নানা বিষয়ে বাঙালির তর্কের ধারা বহু দিনের। ব্যক্তি আক্রমণ এখন যেন মাত্রা ছাড়াচ্ছে। মৈত্রেয়ী বলছিলেন, “গত ৭-৮ বছরে দেশে মানুষের অধিকারগুলো সঙ্কুচিত হয়েছে, রাজনৈতিক লেখালেখির চর্চা কমছে, সমাজমাধ্যমের তরজা বেড়ে চলেছে। ট্রোল-সংস্কৃতি তারই পরিণাম।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

Trolling internet Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE