Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শিশুকে হত্যার পিছনে ‘তন্ত্রসাধনা’, প্রাথমিক ভাবে অনুমান পুলিশের

নিষ্পাপ শিশুর আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছিল। আর তা করা হয়েছিল তখন, যখন সে জীবিত। রাজারহাটের প্রীতি নস্কর খুনের মামলায় এই কারণেই তন্ত্র-যোগের দিকটি বড় হয়ে উঠে আসছে পুলিশি তদন্তে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৪৫
Share: Save:

নিষ্পাপ শিশুর আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছিল। আর তা করা হয়েছিল তখন, যখন সে জীবিত।

রাজারহাটের প্রীতি নস্কর খুনের মামলায় এই কারণেই তন্ত্র-যোগের দিকটি বড় হয়ে উঠে আসছে পুলিশি তদন্তে। ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট জানিয়েছে, মহালয়ার দিন বেলা ১১টা নাগাদ আঙুল কেটে নেওয়ার কিছু পরে খুন করা হয় তাকে। একাংশের মতে, সেই সময়টি ছিল ‘মাহেন্দ্র ক্ষণ’। পুলিশের অনুমান, মাহেন্দ্র ক্ষণে কোনও নিষ্পাপ শিশুর কাটা আঙুল ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করলে সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে ‘ভাল দিন’ ফেরার বিশ্বাস থেকেই প্রীতিকে খুন করা হয়েছে।

মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘অন্ধ বিশ্বাসের এই ইতিহাস বহু দিনের। এখনও বহু মানুষের মনে তা দানা বেঁধে রয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি কাজ করে না।’’ পুলিশ জানাচ্ছে, শহরের উপান্তে বাস করলেও শিক্ষার দিক থেকে এরা পিছিয়ে। কুসংস্কার ছেয়ে আছে এই পরিবারগুলিতে। কিছু দিন আগে প্রীতিদের বাড়িতে চুরি হওয়ার পরে পুলিশের কাছে না গিয়ে গুনিনের কাছে যান প্রীতির বাবা রঞ্জিত। এমনকী, প্রীতিকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশের পাশাপাশি গুনিনেরও কাছে গিয়েছিলেন তাঁরা। শুধু তাঁরাই নন, পুলিশের মতে, ওই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ এখনও এই ঝাড়-ফুঁক, তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাসী।

মনোবিদ অনিন্দিতা রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘কুসংস্কার যে শুধু দরিদ্র মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা-ও নয়। শুনছি, অনেকে জন্মাষ্টমীর দিন শিশুর ডেলিভারি করাতে অতিরিক্ত টাকা খরচেও পিছপা হন না।’’ অনিন্দিতা জানান, বহু নিঃসন্তান দম্পত্তি চাহিদার শেষ সীমায় পৌঁছে, কোনও প্ররোচনায় পা দিয়ে এমনটা ভাবতে শুরু করেন, ভগবানের কাছে একটি শিশুকে পাঠালে বা তার কোনও অঙ্গ কেটে পাঠালে পরিবর্তে তাঁরা সন্তান পাবেন। তাঁর কথায়, ‘‘দেশ জুড়ে শিশু-বলির পিছনে বেশির ভাগই এমন কারণ উঠে আসে।’’

পুলিশ জানাচ্ছে, রঞ্জিতবাবুদের এক পড়শি পরিবারের দীর্ঘদিন সন্তান হচ্ছে না। রঞ্জিতবাবুর ভাই শঙ্করবাবু দারিদ্র ছেড়ে সবে টাকার মুখ দেখছেন। তাঁর বাড়ি থেকেই মিলেছে বস্তাবন্দি শিশুর দেহ। এই দুই পরিবারকে ডেকেই জেরা করেছে পুলিশ। এক জন সন্তানের আশায় অথবা অন্য জন আরও বিত্তবান হওয়ার আশায় শিশুর দু’টি আঙুল উৎসর্গ করেছেন কি না, দেখা হচ্ছে।

সমাজবিদ রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কুসংস্কারের অনেক স্তর রয়েছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে কেউ হাঁচলে অনেকেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরোন, এটি একেবারে প্রাথমিক স্তর। আংটি-তাবিজ-মাদুলি পরে ভাগ্য বদলে ফেলার চেষ্টাও এই বিশ্বাসের অঙ্গ। শিশুর আঙুল কেটে নেওয়াকে এরই চরম স্তর বলা যেতে পারে।’’ তাঁর মতে, যে সব মানুষের আকাঙ্খার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই, চাহিদা যখন নিজের ক্ষমতার সীমা ছাড়ায়, তখন তা পাওয়ার জন্য এমন কিছু ঘটাতে পারে সে।

তন্ত্র মতে

• ‘‘যত দূর জানি, সনাতন ধর্মে এমন নৃশংসতা অনুমোদিত নয়।
তন্ত্রের অজুহাতে এমন কেউ করে থাকলে অবশ্যই তাঁর শাস্তি হওয়া দরকার।’’
তন্ময় বেদান্তশাস্ত্রী (অধ্যাপক, সংস্কৃত কলেজ)

• ‘‘৬৪ রকমের তন্ত্র আছে আমাদের। এমন কোথাও বলা নেই।
শাপমুক্ত হওয়ার নানা রকম উপায় বলা আছে, কিন্তু কোনওটাই এতটা নৃশংস নয়।
এটা স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়।’’ যুগলকিশোর শাস্ত্রী (অধ্যক্ষ, শ্রী পতঞ্জলি বেদ বিদ্যালয়)

• ‘‘যতটুকু জানি, তাতে কখনও এমন নৃশংস ভাবে শাপমুক্তির কথা পাইনি।
কোনও রকম জাদুতেই এ ধরনের কিছু হয় না। এ সব কুসংস্কার।
কিছু মানুষ অন্যের ক্ষতি করে টাকা করার ফন্দি আঁটেন।’’

ঈপ্সিতা রায় চক্রবর্তী (ডাকিনিবিদ্যা বিশারদ)

পুলিশ জানাচ্ছে, তর্জনী ও কনিষ্ঠা, প্রীতির যে দু’টি আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে, কাটতে হলে তা আলাদা আলাদা করে কাটতে হবে। ফলে, মনে করা হচ্ছে, পরিকল্পনা করেই ওই আঙুল দু’টি কাটা হয়েছিল। এক অফিসার জানাচ্ছেন, হিন্দু মতে, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে, রীতি-নীতি ও তন্ত্র-মন্ত্রে এই দুই আঙুলের অনেক ভূমিকা রয়েছে। ফলে এই দুই আঙুলকে নাকি শুভ বলে গণ্য করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, যে কাপড় দিয়ে প্রীতির মুখ বাঁধা ছিল, তার রং লাল থাকার পিছনেও কি কোনও তন্ত্র-যোগ রয়েছে? সাধারণত তান্ত্রিকেরা রক্তবর্ণ কাপড় ব্যবহার করেন বলেই পুলিশের মত। প্রশ্ন উঠেছে, যিনি নিজের সুদিনের আশায় তান্ত্রিকের কথা মতো এই নৃশংস কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তিনি কি বুঝতে পারেননি যে এই খুনের কথা চাপা থাকবে না এবং এক দিন না এক দিন তিনি ধরা পড়বেনই।

মনস্তত্বের শিক্ষক নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, ‘‘যিনি তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁর মনে একটি বিভ্রম থাকে। তিনি কল্প জগতে থাকেন। সেখান থেকে অবাস্তবতার জন্ম হয় আর যথাযথ বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন সেই ব্যক্তি।’’ জয়রঞ্জন জানাচ্ছেন, এমন ক্ষেত্রে খুনের সময়ে হাত কাঁপে না তাঁদের। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, ‘ভাল’ কাজের জন্য এক জনকে বলি দেওয়া হচ্ছে। অনেকটা কাউকে খুন করে দেশের মঙ্গল করার মতো।

এত কিছুর পরেও পুলিশ অবশ্য একশো ভাগ নিশ্চিত করে বলতে চাইছে না, তান্ত্রিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এই খুন। এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘প্রতিহিংসা, পারিবারিক ঝামেলার দিকগুলিও দেখা হচ্ছে। কিন্তু খুনের আগে আঙুল কেন কাটবে, সেই বিষয়টিই বারবার ভাবাচ্ছে।’’ তবে পুলিশ একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে, প্রীতি খুন হয়েছে তার কাকা শঙ্কর নস্করের বাড়িতেই। সেই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বাথরুমে, ঘর মোছার ন্যাতায়, তার কাকিমার ব্লাউজে, সিঁড়িতে রক্তের দাগ পেয়েছে পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investigation child kolkata rajarhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE