অপেক্ষা: ক্রেতা নেই, তাই গালে হাত। মেটিয়াবুরুজে। ছবি: অরুণ লোধ
‘ভো-কাট্টা তোমার ভালবাসা।’
বিশ্বকর্মা পুজোর আর বাকি দু’দিন। কিন্তু শহরের ঘুড়ি বাজারের ছবিটা এমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ঘুড়ির কারখানা বলে পরিচিত মেটিয়াবুরুজের পাহাড়পুর রোডের ছবিটা অনেকটা এরকম— গালে হাত দিয়ে বসা ঘুড়ি ব্যবসায়ী, ঘুমন্ত কর্মচারী, একটিও খদ্দের না থাকা দোকান। এ কিসের সঙ্কেত? তবে কি এ বার মার খাচ্ছে ঘুড়ির বাজার? শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণের অধিকাংশ ঘুড়ি ব্যবসায়ীর উত্তর, হ্যাঁ।
কারণ হিসেবে কোনও ব্যবসায়ীর দাবি, চায়না মাঞ্জার বাজার এখনও গিলছে ঘুড়ির বাজারকে। কারও মতে, জিএসটি-অসুর। রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশে ময়ূরপঙ্খী, মুখপোড়া, চোখ-মার, মোমবাতির পাশে ভাসছে চাঁদ-তারা, চিল— এমন দৃশ্য যে বিরল হচ্ছে, তা মানছেন ঘুড়ি প্রেমিকেরাও।
বৌবাজারের অক্রূর দত্ত লেনের ঘুড়ি শিল্পী নিমাই সেন মারা গিয়েছেন সম্প্রতি। এখন ব্যবসা সামলাচ্ছেন তাঁর ছেলে নীলমণি সেন। তিনি জানান, ঘুড়ি বিক্রি করে লাভ সামান্য। ঘুড়ি ব্যবসায়ীর আসল লাভ লুকিয়ে মাঞ্জায়। ওয়াইনের ভাঙা বোতল, বেলজিয়াম কাচের গুঁড়ো, ভাল আতপ চালের সঙ্গে আরও কিছু মিশিয়ে উত্তরপ্রদেশের বরেলীতে তৈরি হয় বিশেষ মাঞ্জা। যার বাজারদর প্রতি এক হাজার গজে আড়াইশো টাকা। অথচ লোহা গুঁড়ো, লোহা গলানোর বিশেষ কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি চায়না মাঞ্জার দাম হাজার গজে ষাট থেকে সত্তর টাকা। এর দাপটে চার-পাঁচ বছর ধরে মার খাচ্ছে ব্যবসা। তাঁর দাবি, ‘‘কেন্দ্র নিষিদ্ধ করলেও মেটিয়াবুরুজ এবং এন্টালিতে মজুত করে রাখা চায়না মাঞ্জা চোরা পথে এখনও বিক্রি হচ্ছে। ঘুড়ির নতুন কোনও নকশা তো দূরের কথা! কয়েক বছরে পঞ্চাশ শতাংশ ব্যবসা কমে গিয়েছে।’’
জিএসটি-র প্রভাবের গল্প শোনালেন মেটিয়াবুরুজের ব্যবসায়ী এস কে জামিল আখতার। তিনি জানান, ঘুড়ি তৈরি হয় অজন্তা কাগজে। ত্রিবেণী কাগজে তৈরি ঘুড়ি তুলনায় দামি। দু’ধরনের কাগজই আসে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। দু’মাসে রিম প্রতি কাগজের দাম বেড়েছে পঁচিশ থেকে তিরিশ টাকা। অসমের বিশেষ বেত থেকে ঘুড়ির মাঝের কাঠি ঠাড্ডা এবং বাঁকানো কাঠি কামানি তৈরি হয়। দাম বেড়েছে সে সবের। দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে আগরার সুতোও। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ‘‘শুনেছিলাম, ঘুড়ির উপরে জিএসটি হওয়ার কথা পাঁচ শতাংশ। কিন্তু তা কী ভাবে? পুরো ঘুড়ির উপরে? না কী ঘুড়ির বিভিন্ন অংশের উপরে আলাদা আলাদা করে? সেটাই তো আমরা বুঝে উঠতে পারছি না!’’
ঘুড়ির ব্যবসা কেমন চলছে? মেটিয়াবুরুজের কাচ্চি সড়কের দোকানে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা আফতাব আলম বলছেন, ‘‘পুজোর দু’দিন আগে দোকানে আমি আর আপনি। এটাই তো বলে দিচ্ছে ব্যবসার হাল। গত বছরেও বিশ্বকর্মা পুজোর মুখে দিনে কুড়ি হাজার টাকার ব্যবসা হতো। আজ সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে দোকান খুলে এতক্ষণে বিক্রি হয়েছে সাড়ে ছ’হাজার টাকার।’’
যদিও ততটা নিরাশ হতে রাজি নন নীলমণিবাবু। তাঁর মতে, ‘‘সাত-আট বছর আগেও ঘুড়ি ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছিল। ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অনেক অসুবিধার মধ্যেও আশার কথা, এ দেশে এখনও ঘুড়ি পাগল মানুষ আছেন। তাঁরাই বাঁচিয়ে রাখছেন ব্যবসাটা।’’ রাজবল্লভপাড়ার ব্যোমকেশ ঘোষ এবং হৃষীকেশ ঘোষ এমনই দুই ঘুড়ি পাগল। বিশ্বকর্মা পুজো ও বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা মিলিয়ে দুই ব্রাজিল ভক্ত ঘুড়ির নতুন নকশাও করে ফেলেছেন। প্রথম ধাপে দেড়শোটি ঘুড়ির বরাত দেওয়া হয়ে গিয়েছে নীলমণিবাবুকে। ‘‘দামটা একটু বেশি। ঘুড়ি প্রতি পঁচিশ টাকা। মোট পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ঘুড়ি আর ব্রাজিল— দুইয়ে মিলে খরচ করতে আপত্তি নেই একটুও। পাশে রয়েছে পরিবারও।’’ — অকপট হৃষীকেশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy