অপু, ফেলুদা, উদয়ন পণ্ডিত, ময়ূরবাহন, দেবদাস, ক্ষীদ্দা —পর্দায় কত চরিত্র তিনি। মঞ্চেও। অভিনয় থেকে পত্রিকা সম্পাদনা, কবিতা লেখা, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানে নিরন্তর শিল্পিত যাপন। কিংবদন্তি শিল্পীর স্মরণে ‘অপুর পাঁচালী’ নামে একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হল ১৩ জানুয়ারি আইসিসিআর-এ এক রেস্তরাঁয়। পাতায় পাতায় টুকরো সৌমিত্র— সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-তপন সিংহ-অজয় কর-অসিত সেন হয়ে আজকের প্রজন্মের পরিচালকদের ছবিতে তাঁর শৈল্পিক অভিযাত্রা; ছবির পোস্টার, বুকলেট, গানের রেকর্ড কভার, তাঁর নিজের বই ও সম্পাদিত এক্ষণ পত্রিকার প্রচ্ছদ, আত্মপ্রতিকৃতি-সহ অন্য চিত্রশিল্পও। সুদীপ্ত চন্দের ভাবনায়, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় তৈরি এই ক্যালেন্ডার প্রকাশে উপস্থিত ছিলেন আইসিসিআর-এর আঞ্চলিক অধিকর্তা গৌতম দে, সুরজিৎ কালা, সৌগত চট্টোপাধ্যায়-সহ সংস্কৃতি-জগতের বিশিষ্টজন। নীচের ছবি ক্যালেন্ডার থেকে, শিল্পী সিড ঘোষ।
রাত-জাগা গান
লকডাউন, অতিমারির প্রাবল্যে মুষড়ে পড়েছিল ছাত্রছাত্রীরা, তাঁর সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘অশোকরেণু’র বৃহত্তর পরিবার। তখনও ইউটিউব সম্পর্কে জ্ঞান বা আগ্রহ কোনওটাই ছিল না স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের, সে-ও হল, গানে গানে যোগাযোগের সেতু বাঁধতেই। প্রথম গান ওহে দয়াময়, গেয়েছিলেন ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর কথা মাথায় রেখে, সেটাই শুরু। রোজ সকালে ইউটিউবে একটি করে গানের মুক্তি, তার আগে কয়েক ঘণ্টা ধরে রেকর্ড করা। এ ভাবেই দীর্ঘ লকডাউন ও আনলক পর্ব জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন চলেছে স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের নিদ্রাহারা রাতের গান। সঙ্গে প্রতিটি গানের ভাব অনুযায়ী নিজের তোলা ছবি, অল্প কিছু সংগৃহীত। ছবি তোলা তাঁর নেশা, আটটি প্রদর্শনীও হয়ে গিয়েছে কলকাতায়। বাঙালির ইতিহাস, জন্ম বা মৃত্যুদিনে গুণী পূর্বজদের স্মরণও হয়ে উঠেছে গানের উপলক্ষ। রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বটেই, গেয়েছেন সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, অসমিয়া, তামিল, তেলুগু, ইংরেজি, স্কটিশ ভাষায় গান, অন্য বাংলা গানও। আজ সোমবার পর্যন্ত গানের সংখ্যা ২৯৭, ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক-শ্রোতাসংখ্যা ছাপিয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার। ২১ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ৩০০তম গানটি দিয়ে ইতি।
ঘরে বাইরে
শান্তিনিকেতনের ফুলডাঙার একটি ভবন ‘অচিরা’। এখানেই অভিনীত হয়ে চলেছে ‘চতুর্থ মাত্রা’-র অন্য রকম প্রযোজনা। গোটা বাড়িটিই অভিনয়ের ‘স্পেস’, মাসের প্রথম ও তৃতীয় শনিবারে এখানেই অভিনব নাট্যযাত্রা কাবেরী বসু ও শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাবেরী-শান্তনু প্রোডাকশনস’-এর। আধুনিক থিয়েটার চর্চার এক মুক্ত পরিসর ‘চতুর্থ মাত্রা’-র অধীনে ওঁদের উদ্যোগে নাটক হয়ে উঠছে পি সচ্চিদানন্দন বা অসীম চট্টরাজের ছোটগল্প, ইরানের হামিদ মহম্মদ তাহেরির প্রবন্ধ, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত লেখা। এ ছাড়া গ্রিসের ইয়াসুনাস সারাকিস, জাপানের ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার লেখা এবং ফ্রাঙ্কো রামের বেতার-নাটককেও অভিনয়ে রূপ দিয়েছেন কাবেরী-শান্তনু। ঘরের মধ্যে জেগে ওঠে নাটক, বাইরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে আগুন জ্বালিয়েও হয় অভিনয়— উঠোন থেকে মাঠে, বনবীথির মাঝে দিবালোক, বৈদ্যুতিক আলো ছাড়াও মোমবাতি ও মশালের আলোয়। অতিমারির প্রতিক্রিয়ায় ওঁদের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা গ্লাস ওয়াল।
নান্দনিক
“হে কৃপাসিন্ধু পরমেশ্বর। তোমার কৃপায় অদ্য আমাদিগের এই শিশু সন্তান শ্রীমান সত্যজিতের শুভ নামকরণ সম্পন্ন হইল।” ব্রাহ্ম নামকরণপত্রের প্রতিলিপি দিয়ে শুরু কলকাতা পুরসভার পত্রিকা কলকাতা পুরশ্রী-র ‘শতবর্ষে সত্যজিৎ’ বিশেষ সংখ্যা (মুখ্য উপদেষ্টা সন্দীপ রায়, অতিথি সম্পাদক জয় গোস্বামী)। পাঁচশো পাতার সুদৃশ্য নির্মাণ, দুই মলাটের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি ও প্রতিভার স্মরণ। আছে মহানগর ছবির চিত্রনাট্য, ‘অগ্রন্থিত’ বিভাগে গড়পারের বাড়ি ও নন্দলাল বসুকে নিয়ে সত্যজিতের লেখা, সাগরময় ঘোষ ও সুপ্রভা রায়কে লেখা চিঠি। ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেন-আকিরো কুরোসাওয়া-মার্টিন স্করসেসি-উৎপল দত্ত-গুলজার-অপর্ণা সেন-গৌতম ঘোষ-গিরিশ কাসারাভল্লি-শ্যাম বেনেগাল-আদুর গোপালকৃষ্ণণের ‘অভিবাদন’; লীলা মজুমদার-বিজয়া রায়-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-নিমাই ঘোষ থেকে শর্মিলা ঠাকুর-মাধবী মুখোপাধ্যায়-ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়-বরুণ চন্দ-দীপঙ্কর দে-প্রদীপ মুখোপাধ্যায়-মনোজ মিত্র-অলকানন্দা রায়-স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-রঞ্জিত মল্লিকের পর্যালোচনা, ‘বহুবর্ণ’ বিভাগে এ কালের শিল্পী-গবেষক-সন্ধানীদের দৃষ্টিতে জরুরি সত্যজিৎ-বিশ্লেষণ। সন্দীপ রায়ের তোলা একগুচ্ছ ছবিতে ‘আমার লেন্সে বাবা’ (ছবিতে তারই একটি), যোগেন চৌধুরী-শুভাপ্রসন্ন-ইন্দ্রপ্রমিত রায়-সহ বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীদের সত্যজিৎ-প্রতিকৃতি; ঋত্বিক মল্লিক ও শুভব্রত নন্দীর নান্দনিক বিন্যাস ও অলঙ্করণ।
জরুরি কাজ
‘উনিশ এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে শিলং, ধুবড়ি, শিলচর, গুয়াহাটি, আগরতলা, শ্রীহট্ট ও কুমিল্লা ছিল এ অঞ্চলে সাহিত্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। দেশভাগের পর, বাংলাচর্চার প্রকাশ আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে...ঔপনিবেশিক কালে এখান থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র ছিল হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। স্বরাজোত্তর পর্বে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সেই সংখ্যা হয় দ্বিগুণেরও বেশি।’— মন্তব্য সম্পাদকের। তবু আজও উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা কথাসাহিত্যের চর্চা নিয়ে কলকাতার সাহিত্যজগৎ খুব বেশি খবর রাখে না। সে কথাই মনে করাল গুয়াহাটি থেকে কুড়ি বছর ধরে প্রকাশিত পত্রিকা নাইনথ কলাম-এর সাম্প্রতিকতম ‘উত্তর-পূর্বের বাংলা কথাসাহিত্য’ সংখ্যা (সম্পাদক: প্রসূন বর্মন, গোবর্ধন অধিকারী)। ‘আলোচনা’ বিভাগে তিনটি পর্বে দেশভাগ ও উত্তর-পূর্বের বাংলা আখ্যান, মেয়েদের উপন্যাসে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম বাংলা গল্প অচলা, উত্তর-পূর্বের সাহিত্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র-সহ বিবিধ প্রসঙ্গ, ‘পুনরবলোকন’ শিরোনামে ১৮৯৭-১৯৪৭ কালপর্বে লিখিত উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য প্রতিনিধিত্বমূলক আটটি ছোটগল্পের পুনর্মুদ্রণ। এ কাজ অতি প্রয়োজনীয় ছিল।
অন্য ইতিহাস
বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রিত পোস্টকার্ড নিয়ে সম্প্রতি এক অনলাইন প্রদর্শনী আয়োজন করেছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, ডিএজি মিউজ়িয়ামস ও যদুনাথ ভবন মিউজ়িয়াম অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাস ও শিল্প-পরিসরেও পোস্টকার্ডের গুরুত্ব কম নয়, বোঝাতে এদের উদ্যোগে এক আলোচনাসভাও হয়ে গেল গত ৭ জানুয়ারি সন্ধেয়। বিষয় ‘আনপ্যাকিং ফ্যামিলি কালেকশনস: পার্সোনাল আর্কাইভস অ্যান্ড ফ্যামিলি আর্ট হিস্ট্রিজ়’। পোস্টকার্ড লেখার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আর পেশাগত জগৎ মিলেমিশে গিয়ে খুলে দিতে পারে শিল্প-ইতিহাস সংগ্রহের নতুন দিক, স্মৃতির ভাঁড়ারঘরও হয়ে উঠতে পারে জন-ইতিহাস রচনার আকর। বস্তু ও চিত্র নিয়ে গড়ে ওঠা বহতা পারিবারিক ইতিহাস প্রসঙ্গে বললেন মুম্বইয়ের কবি, সমালোচক ও সংস্কৃতি-তাত্ত্বিক রঞ্জিত হস্কটে। অপর বক্তা ইন্দিরা চৌধুরীর কথায় উঠে এল পারিবারিক ইতিহাসের অসম্পূর্ণ ও খণ্ড সম্পদের কথা। সভা পরিচালনায় ছিলেন সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র সাম্মানিক অধ্যাপক তপতী গুহঠাকুরতা।
ক্রিকেট নিয়ে
রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ১৯৪৭-এ ক্রিকেট দল ভেঙে হল এক থেকে দুই। উপনিবেশ-উত্তর যুগে ব্রিটেন-ভারত দু’দেশের সম্পর্কের ছাপ পড়ে ক্রীড়াক্ষেত্রেও, ইংরেজ আধিপত্যের যুগ পিছনে ফেলে ভাল ক্রিকেট-খেলিয়ে দেশ হিসেবে ক্রমশ গুরুত্ব পেতে থাকে একদা-উপনিবেশ ভারত। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাবিত হয়েছে ক্রিকেট, নিজেও প্রভাব ফেলেছে। ভারতীয় খেলাধুলো ও ইতিহাসের এমন এক স্বল্পালোচিত দিক নিয়ে আজ সন্ধে ৭টায় আন্তর্জালিক আলোচনাসভা, ‘উত্তর সাম্রাজ্যবাদ, কূটনীতি ও ক্রিকেট: ভারত ও ইংল্যান্ড (১৯৪৫-১৯৬৯)’। বলবেন ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক সৌভিক নাহা। বিশেষ অতিথি ইতিহাসবিদ সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তী। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করে চলেছে ‘সোসাইটি ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং কালচার অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া (শুচি)’, এটি তাদের ‘ঊর্ণাময়িক বক্তৃতামালা’র দশম পর্ব।
সৌকুমার্য
‘‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে গড়িয়া।/ শাড়িগুলো সব বেচে ফেলিয়াছে, হাঁড়িগুলো আছে পড়িয়া।/ নানা কথা কয় যত নিন্দুকে, তাড়ানোট বাঁধা লোহাসিন্দুকে।/ ছাঁচিপান কোথা? চুন দিয়ে খায় তামাকের পাতা গুঁড়িয়া।/ মিটিং করিতে শহিদ-মিনারে চলে মিনিবাসে চড়িয়া।” আনন্দমেলা-য় রবীন্দ্রনাথ-ফেরতা এই ছড়া লিখেছিলেন ‘শ্রীপঞ্চেটক’। পড়ে সুকুমার মনে হতে পারে, সুকুমারই বটে, তবে রায় নয়— সেন! ১৬ জানুয়ারি জন্মদিন ছিল তাঁর, ভাষা নিয়েই যাঁর ঘর-সংসার।
মানুষের মুখ নিরন্তর ভাবাত তাঁকে