Advertisement
E-Paper

‘ছেলেকে ডাক্তার করতে চাই, তাই এত দূর সঙ্গে করে আনছি’

কয়েক ফুটের মধ্যেই ছিলেন আর এক যুবক। হাতুড়ি-পেটানো থামিয়ে তাঁর ধমক, ‘‘মাকে অত খাটাচ্ছিস কেন? নিজেই তো করতে পারিস!’’ ধমক শুনে ভয় পাওয়া তো দূর, হাসতে হাসতে সেই যুবকের সঙ্গেই পাথর ছোড়ার খেলায় মেতে উঠল শিশুটি।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ১৮:২৯
অপেক্ষা: কাজে ব্যস্ত মা-বাবা। ফুটপাতেই বসে ছেলে। শনিবার, চাঁদনি চকে। ছবি: সুমন বল্লভ

অপেক্ষা: কাজে ব্যস্ত মা-বাবা। ফুটপাতেই বসে ছেলে। শনিবার, চাঁদনি চকে। ছবি: সুমন বল্লভ

পরনে আধ-ময়লা শার্ট আর হাঁটু পর্যন্ত তোলা লুঙ্গি। মাথায় গামছা। দুপুর রোদে ফুটপাতের সিমেন্টের গাঁথনি ভাঙার কাজ করছেন এক তরুণী। খানিক তফাতেই সেই ভাঙা ফুটপাতের উপরে বসা এক শিশুপুত্র। হাত বাড়িয়ে ফুটপাতের এক দিকে দেখিয়ে সে বলছে, ‘‘মা মা এ দিকটা ভাঙা হয়নি। এখানে মারো!’’ হাসিমুখে শিশুর নির্দেশ মেনে নিয়ে বাড়তি উদ্যোগে সে দিকেই গাঁইতি চালাতে শুরু করলেন তরুণী।

কয়েক ফুটের মধ্যেই ছিলেন আর এক যুবক। হাতুড়ি-পেটানো থামিয়ে তাঁর ধমক, ‘‘মাকে অত খাটাচ্ছিস কেন? নিজেই তো করতে পারিস!’’ ধমক শুনে ভয় পাওয়া তো দূর, হাসতে হাসতে সেই যুবকের সঙ্গেই পাথর ছোড়ার খেলায় মেতে উঠল শিশুটি। জানা গেল, তরুণী শিশুটির মা আর ওই যুবক তার বাবা। খানিক পরে মায়ের হাতেই খাবার খেয়ে ফুটপাতের এক কোণে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল শিশুটি।

গত এক সপ্তাহ ধরে চাঁদনি চকের এক ফুটপাতে এ ভাবেই কাজ করে চলেছে দিনমজুর মুণ্ডা পরিবার। প্রতিদিন সকালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার হাঁড়িপোতা গ্রাম থেকে স্ত্রী বসন্তীকে নিয়ে শহরে চলে আসেন ফন্টু মুণ্ডা। সঙ্গে আসে তাদের সাত বছরের ছেলে শুভজিৎ। দিনভর বাবা-মায়ের সঙ্গে ফুটপাতেই থাকে সে। বাবা-মায়ের কাজ দেখে খানিকটা সময় কাটানোর পরে ফুটপাতেই ঘুমিয়ে পড়ে শিশুটি।

এত ছোট ছেলেকে নিয়ে কাজ করতে এসেছেন? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন ফন্টু। তিনি বললেন, ‘‘বাড়িতে ছেলেকে দেখার কেউ নেই। কার কাছে রাখব! তা ছাড়া পাড়ার লোকজন ভাল নয়। আমাদের সঙ্গে থাকলে অন্তত খারাপ হবে না।’’ স্বামীর কথা শেষ না হতেই স্ত্রী বসন্তী বললেন, ‘‘কত দিন এ ভাবে রাখতে পারব জানি না। যে দিন পারব না, সে দিন একা ছেড়ে দেব। কত দিন যে ওকে ভাল ভাবে রাখতে পারব, সেটাই চিন্তা!’’

বসন্তী জানান, শুভজিৎ হাঁড়িপোতা প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। অঙ্কে দারুণ মাথা। আগে ছেলেকে ঠাকুরমা-দাদুর কাছে রেখে আসতেন তাঁরা। তবে সম্প্রতি বসন্তীর শ্বশুর লক্ষ্মীন্দর মুণ্ডা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে শয্যাশায়ী। তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন শাশুড়ি লক্ষ্মীমণি। ফলে তিনি এখন আর নাতির দেখাশোনা করতে পারেন না।

তিনি জানালেন, ১৫ বছর ধরে দিনমজুরির কাজ করছেন ফন্টু। প্রতিদিন সকালে মৌলালি এলাকায় এসে কাজের খোঁজ নেন তিনি। কাজ থাকলে চলে যেতে হয় কর্মস্থলে। দৈনিক ৩৫০ টাকা পান। তবে ফন্টুর একার আয়ে সংসার চলে না। তাই ফন্টুর স্ত্রী বসন্তীও এখন স্বামীর সঙ্গে দিনমজুরির কাজে যোগ দিয়েছেন। জানালেন, তিনি দৈনিক পান ২৫০ টাকা। বসন্তীর কথায়, ‘‘১২ বছর আগে আমাদের বিয়ে হয়। একা ওর পক্ষে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই আমিও কাজ করি এখন। তবে আমি মেয়ে বলে ১০০ টাকা কম দেয়। আমাদের লাইনে ছেলেদের বেশি আয়।’’

তবে এত লড়াইয়ের মধ্যেও ছেলেকে নিয়ে মুণ্ডা দম্পতির অনেক স্বপ্ন। ‘‘ছেলেকে ডাক্তার করতে চাই। ও যাতে খারাপ না হয়ে যায়, তাই এত দূর সঙ্গে করে আনছি।’’ কিন্তু এর ফলে যে স্কুল যাওয়া হচ্ছে না? বসন্তী বলেন, ‘‘কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেব। ও একটু বুঝতে শিখলেই একা ছাড়ব। তত দিন ও আমার কাছেই থাক।’’ ছেলের জন্য ভাত আর আলুভাজা মাখতে মাখতে তিনি আরও বলেন, ‘‘ছেলের আমার কোনও জ্বালা নেই। একটু ভাজা হলে আর কিছু চায় না। রাস্তাতেও আমাদের হাঁড়ি এক। ঠিকাদার সেই বুঝেই আমাদের কাজ দেয়। সব জায়গায় তিন জনেই যাই।’’

আর শিশুটি? বাবা-মায়ের সঙ্গে রোজ আসতে ভাল লাগে? প্রশ্ন শুনে কোনও উত্তর নেই শিশুটির মুখে। বাবা শুধু হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘সকালে উঠেই বলে বাবা কাজে যাব। আমি বলি, তুমি কাজ করো, আমি আর মা বসে বসে খাব!’’

Labourer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy