Advertisement
E-Paper

অপারেশন আলিপুর! শাসকের হয়ে ‘কাজ’ সারল যে দাগী আসামিরা

সোমবার দফায় দফায় অভিযোগ আসতে থাকে আলিপুর জেলাশাসকের অফিস নিয়ে। এই মহিলা সাংবাদিককে ‘অপহরণ’ তো ঠিক তার পরেই অন্য এক সাংবাদিককে মারধর করে ঘড়ি, মোবাইল কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৮ ১৪:২৬

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন ঘিরে যে তাণ্ডব দেখল গোটা রাজ্য, তার সরাসরি আঁচ থেকে মুক্তি পায়নি খাস কলকাতাও। আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের অফিসে গত সোমবার যে ভাবে আটকানো হল, তুলে নিয়ে যাওয়া হল, মারধর করা হল বিরোধী প্রার্থী থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের, সেই অপারেশনে নামানো হয়েছিল চেতলা-কালীঘাট-আলিপুর এলাকার দাগীদের।

ওই দিন সকাল থেকেই প্রস্তুতি ছিল তুঙ্গে। কিন্তু গোটা অপারেশনের পিছনে ছিল কারা? খোঁজ করতে গিয়ে নাম বেরিয়ে এল একে একে। এই সব নাম উঠে এসেছে পুলিশের গুন্ডাদমন শাখার করা খোঁজখবরেও।

সোমবার দফায় দফায় অভিযোগ আসতে থাকে আলিপুর জেলাশাসকের অফিস নিয়ে। এই মহিলা সাংবাদিককে ‘অপহরণ’ তো ঠিক তার পরেই অন্য এক সাংবাদিককে মারধর করে ঘড়ি, মোবাইল কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ। শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের কাছে একের পর এক ফোন যেতে থাকে। সেই রেশ কাটার আগেই আলিপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করে ভাঙড়ের জমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। হাইকোর্টের বিশেষ নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে রীতিমত হেনস্থা হতে হয় তাঁদের। অভিযোগ, জেলাশাসকের দফতরে ঢোকার আগেই তাঁদের ঘিরে ধরে কিছু দুষ্কৃতী। তাঁদের আটকে রেখে, নথিপত্র সব ছিঁড়ে ফেলা হয়। হাইকোর্টের কথা মাথায় রেখেই টনক নড়ে লালবাজারের কর্তাদের। তড়িঘড়ি গুন্ডাদমন শাখাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অপারেশন আলিপুরের কুশীলবরা।

১৮ নম্বর মনোহরপুকুর রোডের বাসিন্দা এক যুবক, যে সোমবার জেলাশাসক দফতরের চত্বরে ছিল দিনভর, তার কাছ থেকেই গোটা অপারেশনের পরিকল্পনা আর কুশীলবদের তথ্য সংগ্রহ করেছে গুন্ডাদমন শাখার এক সোর্স। তার কাছ থেকেই জানা যায়, দক্ষিণ কলকাতার দুই দাপুটে নেতা- কালীঘাটের কুমার সাহা এবং আলিপুরের বিপ্লব মিত্রর দায়িত্ব ছিল গোটা অপারেশনের।

গোয়েন্দাদের দাবি, সকাল ৯টা থেকেই ময়দানে নেমে পড়েন দুই নেতার অনুগামীরা। আলিপুর থানার ওসি প্রসেনজিত ভট্টাচার্যর উপস্থিতিতেই ‘আরটিও অফিসে কাজ আছে’ বলে জেলাশাসকের দফতরে ঢুকতে থাকে একের পর এক বাইক। খানিক পরেই অবশ্য ওসি ‘সতর্ক’ হয়ে বাইক আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তত ক্ষণে অন্তত ৭০টি বাইক ঢুকে গিয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক বাছাই করা কর্মীরা ঢুকে যান জেলাশাসকের অফিসের একেবারে ভিতরে। বাকি শ-তিনেক তখন বাইরে বিভিন্ন গেটের পাহারায়, যাতে কোনও ভাবে মাছিও গলে ঢুকতে না পারে।

‘সেনা’ মোতায়েনের খানিক পরেই ‘লাইন অফ অ্যাকশন’-এ পৌঁছে গিয়েছেন দুই সেনাপতি বিপ্লব মিত্র এব‌ং কুমার সাহা। বিপ্লব স্বীকার করেছেন যে ওই দিন তিনি জেলাশাসক অফিস লাগোয়া আদালত চত্বরে ছিলেন ‘ব্যক্তিগত কাজে’। যদিও তাঁর কথায়, “সাংবাদিকদের আটকে রাখা বা মারধর যারাই করে থাকুক না কেন, খুব খারাপ করেছে। তবে আমার কোনও ছেলে এই সব কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়। সে দিন আরও অনেক লোকজন ছিল ওখানে। তাদের কাজ হতে পারে।” কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, সোমবার বিপ্লব মিত্রর সঙ্গে দেখা গিয়েছে চেতলার ২২ নম্বর বস্তির পিন্টু ও তার দলবলকে। রাজনৈতিক কর্মীর থেকেও পিন্টু ও তার গডফাদার সাহেব এলাকায় দুষ্কৃতী হিসেবেই বেশি পরিচিত। স্থানীয় থানায় দুজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে ডজনখানেক মামলা।

অন্য সেনাপতি কুমার সাহার অবশ্য দাবি, সোমবার তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। তাই বাড়ি থেকেই বেরোননি।

কিন্তু গুন্ডাদমন শাখার কাছে তথ্য— সোমবার জেলাশাসক দফতরে যারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যে ছিল মোটা বাবু, খোকন সর্দার, বিশ্বজিৎ, অসীম, বিমল, জয়ন্ত নস্কর ওরফে জতন-রা। আর তাদের সঙ্গে ছিল কালীঘাটের ছোটু, রাজুরা। এরা প্রত্যেকেই হয় ঝালার মাঠ নয়তো লকার মাঠ এলাকার বাসিন্দা। কালীঘাট এলাকার মানুষ এদের কুমারের দলবল হিসেবেই চেনে। যদিও কুমারের দাবি, উনি এদের কারওর নামও নাকি শোনেননি। সোমবার আলিপুর আদালত চত্বরে মোতায়েন থাকা এক পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল জগন্নাথ আর সানি। জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসান ঘিরে গণ্ডগোলে ভবানীপুর থানা ভাঙচুরের মূল পাণ্ডা এই জগন্নাথ। আর হাজরার জিঞ্জার পানশালায় গুলি চালানোর ঘটনায় অভিযুক্ত সানি। দুজনেই নাকি ‘ব্যক্তিগত কাজে’ ওই দিন ওখানে গিয়েছিল।

সোমবার মনোনয়ন ঘিরে জেলাশাসকের অফিসে যাতে কোনও অশান্তি না ছড়ায় তার জন্য পুলিশি প্রস্তুতি ছিল অনেক। জলকামান, র‌্যাফ থেকে শুরু করে বিশাল বাহিনি সবই ছিল। উপস্থিত আলিপুর ও লাগোয়া থানা এলাকার অফিসাররাও। কিন্তু তার পরও এই দাগীরা ওই এলাকায় সবার নজর এড়িয়ে কী করে ঢুকে পড়ল এটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তাই গুন্ডাদমন শাখার কাছে সব তথ্য পৌঁছনর পরও কি আদৌ ‘খুঁজে’ পাওয়া যাবে এদের, যারা সোমবার দিনভর দাপিয়ে গেল জেলাশাসকের দফতরে? কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সুপ্রতিম সরকারের সংক্ষিপ্ত জবাব, “যে যে অভিযোগ আমরা পেয়েছি, তার তদন্ত চলছে।”

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

crime politics operation alipore panchayat election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy