Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Calcutta News

বিনি সুতোর বাঁধনেই ‘সোনা মা’ মুনমুন

রক্তের সম্পর্কহীন ছেলেমেয়েদের আঁকড়েই মাতৃত্বকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ‘নির্দোষ’ তকমা নিয়ে বেরিয়ে নানা কাজে ঘাড় সোজা করে বাঁচছেন এখন।

‘ছেলে’ চিরঞ্জীব গুহের সঙ্গে নাটকের মহড়ায় মুনমুন বসু। নিজস্ব চিত্র

‘ছেলে’ চিরঞ্জীব গুহের সঙ্গে নাটকের মহড়ায় মুনমুন বসু। নিজস্ব চিত্র

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৮ ০২:২৪
Share: Save:

বুকে লেপ্টে থাকা অবোধ দু’টি শিশুকে ছেড়ে জেলে ঠাঁই হয়েছিল তাঁর। দেড় যুগ বাদেও সেই ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগেনি।

তবু রক্তের সম্পর্কহীন ছেলেমেয়েদের আঁকড়েই মাতৃত্বকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ‘নির্দোষ’ তকমা নিয়ে বেরিয়ে নানা কাজে ঘাড় সোজা করে বাঁচছেন এখন। স্বামীকে খুনের ভুয়ো অভিযোগে গারদের আড়ালে জীবনের ১৩টা বছর ফেলে আসা অপরাজিতা ওরফে মুনমুন বসু।

বন্দিজীবনে এক সময়ে নাচ-নাটকের তালিমেই নতুন করে বাঁচার তাগিদ খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। এ বার নাটকের সুবাদেই বন্ধন হঠাৎ পাওয়া ছেলের সঙ্গে। ‘ছেলে’ চিরঞ্জীব গুহের পরিচালনায় মুনমুন এখন ‘বিষাক্ত পাঞ্চালী’ নাটকটির একটি বড় চরিত্রে মহড়া দিচ্ছেন। ঘটনাচক্রে এই নতুন ছেলের জন্মদিনও মুনমুনের বড় ছেলের জন্মদিনেই। ‘‘মাস কয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখেই আমার স্বর্গীয় মায়ের মুখটা মনে পড়ে গেল। দ্রুত উনি আমার মামণি হয়ে উঠলেন।’’— বলছেন ত্রিশোর্ধ্ব চিরঞ্জীব। মুনমুনের থেকে বছর পনেরোর ছোট হবেন তিনি।

চিরঞ্জীব একা নন, তাঁর স্ত্রী নাটকের আরও এক কুশীলব দেবিনার কাছেও মুনমুন ‘সোনা মা’। ছেলেমেয়ের তালিকাটি রীতিমতো লম্বা! জেল থেকে বেরিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছিলেন একদা বন্দিনী। প্রথমে বিনা বিচারে আটকে থাকা কয়েদি বা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মামলা সরকারের কানে তোলার দিকটা দেখতেন তিনি। অ্যাসিড-আক্রান্ত নারী কিংবা বৈষম্যের শিকার রূপান্তরকামী মেয়ে-পুরুষদেরও তিনি ভরসা হয়ে উঠেছেন। জেলের স্কুলে বন্দিনীদের শিশুরা এক সময়ে ‘মন মা’ বলে ডাকত মুনমুনকে। সুহৃদমহলে অপরাজিতা নামে পরিচিত মুনমুন এখন পাতানো ছেলে-মেয়েদের ‘অপা মা’ হয়ে উঠেছেন।

তবে নিজের ছেলেরা এখনও পুরোটা সহজ হতে পারেননি জেল-খাটা মায়ের সঙ্গে। তাতে পিছনে হাঁটতে চান না মুনমুন। ‘‘ওরা ছোট থেকে কত লোকের কাছে কথা শুনেছে! সব কিছু ভুলতে হয়তো আরও সময় লাগবে’’ —ছেলেদের প্রসঙ্গে বলছেন মুনমুন। একদা নিম্ন আদালতে স্বামীকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা পেলেও পরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বলে, তাঁর স্বামী কুণাল বসুর খুনি নান্টু রায়ের সঙ্গে কোনও যোগসাজশ ছিল না মুনমুনের, খুনের চক্রান্তের কিছুই জানতেন না তিনি।

জেলে থাকাকালীন ছেলেদের জন্মদিনে সবাইকে লজেন্স দিতেন মুনমুন। বেরিয়ে এসে জন্মদিনে তাদের পায়েস খাওয়ানোর সুযোগ পাননি। তবে ‘ছেলে’ চিরঞ্জীবের জন্মদিনে এ বার পাঁঠার মাংস-ভাত রেঁধে খাওয়ানোর পরিকল্পনা ঠিকঠাক।

জেলে ‘মাদার্স ডে’-র কথাও জানত না সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন বুভুক্ষু মাতৃহৃদয়। রবিবার মায়েদের এই দিনে অবশ্য ‘ছেলে-বউমা’ গোটা সকালটা ‘মামণি’র কাছেই ছিল। নাটকের মহড়াও চলেছে। আগামী ৪ জুন তপন থিয়েটারে নাটকের প্রথম শো। চিরঞ্জীবের কথায়, ‘‘নাটকে মামণির চরিত্র ‘বাণী দিদি’ এক প্রতিবাদী মেয়ে, যিনি অন্য মেয়েদের অন্যায়ের সঙ্গে লড়তে শেখান। নিজের জীবনে এত বড় দুর্যোগের সঙ্গে হার না-মানা লড়াইয়ের পরে আর কাকেই বা ওই জায়গায় ভাবতাম।’’

বন্দি জীবনে জেলের ‘বিসর্জন’-এ রানি গুণবতী কিংবা ইংরেজি নাটক ‘বেগম সামরু’র জুলেখা মুনমুন উপভোগ করছেন এই অভিনয়-পর্ব। তবে ছেলের প্রতি টানটাই তাঁর আসল প্রেরণা। জেল থেকে মুনমুনের আলোয় ফেরার অন্যতম প্রেরণা নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের কথায়, ‘‘মা হওয়া তো শুধু রক্তের সম্পর্কের ব্যাপার নয়! মুনমুনের ভেতরের মমতা ভরা মনটাই আসল।’’

এ দিন কসবায় একটি সংস্থার ‘মাদার্স ডে’র অনুষ্ঠানের মুখও এ বার মুনমুন। বলছেন, ‘‘কখনও ভাবিনি এত জনের মা ডাক শুনব।’’ নির্দোষ তকমা নিয়ে বেরিয়েও দুর্ভাগা মায়ের সাজা ভুগতে থাকা ‘অপরাজিতা’র জীবনের এটাই সম্বল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Moon Moon Basu Prisoner
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE