Advertisement
E-Paper

ওই চাঁদ সকলের, জানে নাখোদা মসজিদ!

এমনিতে কচ্ছের মেমন সম্প্রদায় প্রথম কলকাতায় পা রেখেছিল ১৮২০ সালে। সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই জাহাজ, চিনির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৮ ০২:৩৮
ঐতিহাসিক: নাখোদা মসজিদ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

ঐতিহাসিক: নাখোদা মসজিদ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

গুগল সব সময়ে ঠিক বলে নাকি! গুগল তো অনেক সময়ে এটাও বলে যে, কাশ্মীর ভারতের অংশ নয়। সেটা কি ঠিক?

নবরূপে সংস্কারের পরে নাখোদা মসজিদের দোতলার ঘরে বসে কথাগুলি বলছিলেন মহম্মদ ইকবাল। অতীতে নাখোদা মসজিদ তৈরি ও পরবর্তীকালে তার সংস্কারের পিছনে গুজরাতের কচ্ছের মেমন সম্প্রদায়ের যে পরিবারগুলির সর্বাধিক অবদান রয়েছে, সেই পরিবারেরই অন্যতম উত্তরসূরি হলেন ইকবাল। ইকবাল বলছিলেন, ‘‘কোনও এক জন কিন্তু নাখোদা মসজিদ তৈরি করেননি। অনেক সময়েই গুগল ভুল বলে। তাই গুগলে বিশ্বাস করবেন না। ইতিহাস বলছে, অনেক পরিবারের সম্মিলিত অবদান হল এই নাখোদা মসজিদ।’’ ইকবাল যেখানে বসে কথাগুলি বলছিলেন, তার কিছুটা উপরে মসজিদেরই একটি মিনারের ভিতরে তখন চিলের ডানা ঝাপটানোর শব্দ ভেসে আসছে। মসজিদের ভিতরে শান্ত, নিঝুম, ঠান্ডা বিশাল ঘরে তখন অনেকে শুয়ে। ইকবালের কথামতো তাঁরা সকলেই ‘মুসাফির’! কাজের সূত্রে এসেছেন। এখন রোজা চলছে। তাঁরা আর কোথায় যাবেন? তাই মসজিদে ঢুকে পড়েছেন।

১৯২৬-এ তৈরি নাখোদা মসজিদ স্থাপত্যের দিক থেকে এমনিতেই যেন এক বিস্ময়। সাদা মার্বেলের দেওয়াল, বেলজিয়াম কাচ, বিশাল নমাজ পড়ার জায়গা, দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো কাঠের ঘড়ি— সব মিলিয়ে ছত্রে-ছত্রে ইতিহাসের গন্ধ। অবশ্য ১৯২৬ সালের আগেও নাখোদা মসজিদের একটা ইতিহাস ছিল। বর্তমানে যেখানে নাখোদা মসজিদ রয়েছে, তখন সেখানে দু’টি ছোট মসজিদ ছিল। কচ্ছের মেমন সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষই সেই দু’টি মসজিদকে একত্র করে নাখোদা মসজিদের বর্তমান কাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন।

মহম্মদ ইকবাল (বাঁ দিকে) এবং মহম্মদ জাহির আহমেদ। নিজস্ব চিত্র

এমনিতে কচ্ছের মেমন সম্প্রদায় প্রথম কলকাতায় পা রেখেছিল ১৮২০ সালে। সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই জাহাজ, চিনির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার পরে তাঁরা মিশে যান এ শহরের সঙ্গে। তাঁদের সংস্কৃতি ক্রমশ এ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। যে সংস্কৃতি, স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হল নাখোদা মসজিদ!

গত দু’বছর ধরে সেই মসজিদেরই সংস্কারের কাজ হয়েছে। নতুন রং করা থেকে শুরু করে হেরিটেজ স্থাপত্যকে অবিকৃত রেখে সংস্কারের জন্য তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে রাজমিস্ত্রি! শেষে মুর্শিদাবাদ থেকে মসজিদের স্থাপত্যের কাজের জন্য রাজমিস্ত্রি নিয়ে আসা হয়। ইকবালের কথায়, ‘‘আমরা অনেক খুঁজেছিলাম মিস্ত্রি। দৈনন্দিন যিনি মসজিদের নির্মাণ সংক্রান্ত কাজের দেখভাল করেন, সেই শেখ মেহফজুলের পরামর্শেই মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমিস্ত্রি আনা হয়েছিল। তাঁদের রীতিমতো ইন্টারভিউ করেছিলাম আমরা।’’ তবে নাখোদার সংস্কারে কত খরচ হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও কথা বলতে নারাজ তিনি। সেটা জানতে চাওয়া হলে ইকবাল হেসে বলেন, ‘‘এটা বলা সম্ভব নয়!’’

দোতলার ঘরে ইকবালের পাশেই বসেছিলেন ইমাম নূর আলম। তিনি বলেন, ‘‘১৫ বছর ধরে রয়েছি। কত পরিবর্তন দেখলাম।’’ পরিবর্তনই বটে! ছোট দু’টি মসজিদ থেকে শুরু করে ক্রমশ তা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শহরের স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হয়ে ওঠা— এক দিনে হয়নি, জানাচ্ছিলেন মসজিদের ট্রাস্টির এক সদস্য। আর এক সদস্য মহম্মদ তারিক বলেন, ‘‘ছেলের স্কুলে ঐতিহাসিক স্থান নিয়ে প্রোজেক্ট ছিল। বললাম, নাখোদাতেই চল। এর থেকে বড় ইতিহাস আর কী-ই বা আছে!’’

মসজিদের সংস্কারের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ বার ভিতরের কাজ শুরু হবে— মসজিদের ট্রাস্টির সদস্যদের একাংশ জানাচ্ছিলেন সে কথা। এক সদস্যের কথায়, ‘‘মসজিদের ভিতরে যে ঝাড় রয়েছে, সেগুলি এ বার সংস্কার করা হবে। পুরনো রাজবাড়ি, প্রাসাদে যেমন রং দেখা যায়, সেটাও করা হবে। তবে আর কিছু দিন বাদে।’’

এমনিতে রমজান বা ইদের চাঁদের বিষয়ে নাখোদা মসজিদের ঘোষণাই শেষ কথা। মসজিদের উচ্চতম মিনারে সবুজ আলো জ্বেলে বোঝানো হয় রমজান শুরু। আবার মিনারেরই সবুজ আলো দেখে বোঝা যায়, রমজানের উপবাস শেষ হল। ‘‘কোনও রাজা বা নবাব এই মসজিদ তৈরি করেননি। আমাদের মতো সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের অর্থে এই মসজিদ তৈরি হয়েছিল। তার সংস্কারও আমরাই করেছি।’’ বলছিলেন মহম্মদ জাহির আহমেদ, কচ্ছের মেমন সম্প্রদায়ের পরিবারগুলির আর এক উত্তরসূরি।

তবে নাখোদা মসজিদের সবচেয়ে বড় গর্ব হল, এটা ভারতের। এটা ভারতীয়দের তৈরি করা, বলছিলেন ট্রাস্টির সদস্যেরা। ইকবাল, জাহিরের কথায়, এটা ভারতীয়দের গৌরব। প্রজন্মবাহিত গৌরব! আর যে চাঁদ রমজান, ইদের সময়ে মসজিদের উপরে নেমে আসে, সে চাঁদ বিশেষ কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়ের চাঁদ নয়, সে চাঁদ ভারতের— নাখোদা মসজিদ মনে করায় সে কথা!

Nakhoda Mosque Reformation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy