প্রতীকী ছবি।
দিব্যি চলছিল পড়াশোনা। কিন্তু মেয়ের বয়স হয়েছিল পঁচিশ। তাই ‘সময়’ পেরিয়ে যাওয়ার আগে বিয়েটা করতেই হল শ্রাবন্তী মিত্রকে। ইচ্ছে ছিল স্নাতকোত্তর পাশ করে গবেষণা করবেন। কিন্তু তা আটকে থাকল ডায়েরির পাতায়। কারণ, শ্বশুরবাড়ির বৌয়ের পড়াশোনা না-পসন্দ। শেষ পর্যন্ত বাড়ির ‘জেদি’ ছোটো বৌয়ের পরিণতি, বন্ধ ঘরে ঝুলন্ত দেহ!
বছর তেইশের অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় নার্সিংহোমে নার্সের চাকরি করতেন। আর্থিক ভাবে স্বর্নিভর হয়েও অভিযোগ, শ্বশুরবাড়িতে খাবার জুটত না তাঁর। কাজে যাওয়ার সময়ে বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে যেতেন। রোজ মাকে জানাতেন, থাকতে পারছেন না তিনি। মায়ের পরামর্শ ছিল, চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার। অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের দিনভর খোঁজ না পেয়ে রাত দেড়টায় শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দেখেছিলেন, গলায় ওড়না জড়ানো অবস্থায় খাটের উপরে মেয়ের দেহ পড়ে রয়েছে।
রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পারিবারিক হিংসার ভয়াবহতা শুনে অনেক সময়ে শিউরে ওঠেন শহরবাসী। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান বলছে, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার আঁতুড়ঘর কলকাতার ছবিও যথেষ্ট দুশ্চিন্তার।
সম্প্রতি এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মানিকতলার অর্পিতা বা দমদমের শ্রাবন্তী ব্যতিক্রম নন। এ শহর পারিবারিক হিংসায় দেশের অন্য বড় শহরের মধ্যে দ্বিতীয়। বিয়ের পরে পারিবারিক হিংসার ক্ষেত্রে দিল্লির পরেই কলকাতা। তার পরে তালিকায় রয়েছে মুম্বই এবং চেন্নাই। বছরে প্রায় ৮৭৬টি পারিবারিক হিংসার ঘটনা ঘটে কলকাতায়। পাশাপাশি, পণের জন্য মৃত্যুর ঘটনাতেও এ শহর দ্বিতীয়। বছরে পনেরো জন মহিলা এ শহরে পণের জন্য মারা যান। হিসাব বলছে, গত এক দশকে কলকাতায় মহিলাদের উপরে পারিবারিক হিংসা বেড়েছে কয়েক গুণ।
নারীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যেরা জানাচ্ছেন, কলকাতায় পারিবারিক হিংসার ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সরাসরি খুন না করলেও মেয়েদের আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে এক রকম বাধ্য করা হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের মানসিক অত্যাচারের জেরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই। যার জেরেই চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক কর্মীর কথায়, ‘‘পোষ্যের মৃত্যুর পরে তার প্রতি যেটুকু সহমর্মিতা দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে বাড়ির বৌয়ের মৃত্যুর পরে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের মধ্যে সেটুকুও খুঁজে পাওয়া যায় না। বৌয়ের নাক উঁচু প্রকৃতি কিংবা বদমেজাজ নিয়ে আলোচনা চলে।’’
শহরের এই ছবি দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, স্বনির্ভরতা, শিক্ষার প্রসারের পরেও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার লড়াই শেখায় কি ফাঁকি থেকে যাচ্ছে? খাস কলকাতায় যদি মহিলাদের উপরে পারিবারিক হিংসার এই ছবি পাওয়া যায়, তা হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা কী হবে?
এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী স্বাতী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ শহরে সামাজিক অবস্থা খুব খারাপ। রাজ্যের অন্য অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও করুণ। পরিস্থিতির বদলের জন্য কিছু আইন তৈরি পর্যাপ্ত নয়। সর্বস্তরে সচেতনতা দরকার। স্কুল থেকে হাসপাতাল, সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়!’’ রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পারিবারিক হিংসার মূল কারণ পণপ্রথা। টিবি-পোলিও নিয়ে যে হারে প্রচার হয়েছে, এই সামাজিক অসুখ নিয়েও সে রকম প্রচার দরকার। মেয়েদের যেমন লড়াই করতে শেখা দরকার, ছেলেদের তেমন লজ্জা পেতে হবে। এই শিক্ষার শুরু হতে হবে স্কুল স্তর থেকে। তবে এ দেশে পণপ্রথাকে বেআইনি ঘোষণা করার আইন সাংসদে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে পাশ হয়েছিল। সেই ছবি থেকেই এই সামাজিক অসুখের অবস্থা বোঝা যাচ্ছে।’’
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় জানান, সংবিধানে মেয়েদের আইনি অধিকার কী রয়েছে, সে সম্পর্কে সহজ বাংলায় বই প্রকাশের জন্য উদ্যোগী হয়েছে কমিশন। স্কুল, কলেজ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং পুলিশের সাহায্যে এগুলি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। মেয়েদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতেই এই পরিকল্পনা। তাঁর কথায়, ‘‘সমীক্ষার পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনক। দিন দিন হিংসা বাড়ছে। তবে সচেতনতাও কিছুটা ছড়িয়েছে। কারণ, মেয়েরা অভিযোগ জানানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছেন। কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। পরিকল্পনা চলছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy