ফ্রেম-বন্দি। ক্রেগ ও মিরইয়াং হল। বৃহস্পতিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
বাইরে বৃষ্টি। অনেক ক্ষণ ধরেই ঝিরঝির করে শুরু হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যেই ম্যাক বাইরে চলে গিয়েছিল। তার পরে সেখানেই দাঁড়িয়ে। কী মনে করে কে জানে! বৃষ্টিতে ম্যাককে ভিজতে দেখে উদ্বিগ্ন গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী। যদি শরীর খারাপ হয়! দু’জনেই দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না ম্যাক ভিতরে আসে। ম্যাক ভিতরে ঢোকার পরে নিশ্চিন্ত দু’জন। তার পরে ফের কথা শুরু করলেন।
‘‘হ্যাঁ যেটা বলছিলাম, আঁকাটা কিন্তু কলকাতায় এসেই শুরু করেছি। আগে কখনও আঁকিনি। এই শহরের মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা আমাকে আঁকতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’’— পোষ্য কুকুর ম্যাক ভিজেছে কি না দেখতে-দেখতেই কথাগুলো বলছিলেন কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল ক্রেগ হল। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু ছবি আঁকেন। জানেন তো? ‘‘হ্যাঁ, জানি তো!’’, উত্তর দেওয়ার পরেই কনসাল জেনারেলের সহাস্য সংযোজন, ‘আমিও তা হলে রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে পারি, কী বলেন?’ কথাটা শুনে তাঁর স্ত্রী মিরইয়াং হলও তখন মুচকি মুচকি হাসছেন। তিনিই জানালেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ক্রেগের আঁকা ছবি ইতিমধ্যেই প্রশংসা কুড়িয়েছে। ‘‘ওঁর আঁকা ছবির তো ফেসবুকে নিজস্ব পেজও রয়েছে। সেখানে অনেকে প্রশংসাও করেছেন’’, ‘শিল্পী’ জীবনসঙ্গীকে নিয়ে তখন গর্ব মিরইয়াংয়ের চোখে-মুখে।
হো চিন মিন সরণিতে মার্কিন কনস্যুলেট অফিসের পাশে কনসাল জেনারেলের ভবনে সহাস্য ওই দম্পতিকে দেখে তখন কে বলবে, বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের প্যাকিং চলেছে। প্যাকিং কারণ, তিন বছরের কলকাতাবাসের পরে এ বার দেশে ফেরার পালা ক্রেগদের। এখানে কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে ক্রেগের। আগামী সপ্তাহেই তাঁরা বাড়ি ফিরবেন। ছেলে টাইলার এই মুহূর্তে ছুটিতে কলকাতায়। মেয়ে অ্যানা ফিরে গিয়েছেন দেশে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছেন হল-দম্পতি ও টাইলার। দোহায় মার্কিন এয়ারফোর্সের সেন্ট্রাল কম্যান্ডের নীতি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব সামলাবেন ক্রেগ।
শেষ মুহূর্তে মুহুর্মুহু অতিথি-স্রোত ভবনে। কারণ তিন বছরে ক্রেগ ও মিরইয়াং শুধু তো আর সামাজিক শ্রেণি বা স্তর বিচার করে মেশেননি, বরং সব স্তরের সঙ্গে নিজস্ব যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন। সখ্য হয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। ঘুরেছেন বাস, মেট্রোতেও। কনসাল জেনারেলের পোশাকি পরিচয় ভেঙে, আমেরিকা-ভারতের ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ সম্পর্ক রক্ষার গুরুদায়িত্ব সামলেও হল-দম্পতি বন্ধু হয়েছেন শহরের, এখানকার মানুষের। ক্রেগ বলছিলেন, ‘‘আসলে এখানকার মানুষের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যাওয়া যায়। দ্রুত সংযোগ স্থাপন করা যায়। এটা এ শহরের একটা প্রধান চরিত্র।’’ তার পরে একটু থেমে, ‘‘আমার মনে হয় চুম্বকের দুই বিপরীত মেরু একই ভাবে অবস্থান করছে যেন শহরের মধ্যে। ভাল দিক যেমন আছে, খারাপ দিকও আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা অফুরান এনার্জি রয়েছে শহরটায়।’’
আর সেই প্রাণশক্তির সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন দু’জন। অফুরান প্রাণশক্তি আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তাঁদের ভ্রাম্যমাণ দাম্পত্যে রবীন্দ্রনাথ অনেকটা জুড়ে রয়েছেন, জানালেন মিরইয়াং। এমনিতে দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ের বরাবরের টান ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই, বলছেন মিরইয়াং। শিলিগুড়ি, ত্রিপুরা, শান্তিনিকেতন থেকে শুরু করে অনেক জায়গাতেই তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন এই ক’বছরে। শুধু গান গাওয়াই নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে রবীন্দ্রসঙ্গীত— মিরইয়াং গভীর ভাবে তা বিশ্বাস করেন। তাঁর কথায়, ‘‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে সকলের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যাওয়া যায়। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর মাধ্যম কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত!’’
কিন্তু এ সবের মধ্যেও আক্ষেপ রয়েছে কনসাল জেনারেলের। ক্রেগ জানাচ্ছেন, গত দু’দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য লেনদেন অনেকটা বেড়েছে ঠিকই। ২০০১ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ যেখানে ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার, সেখানে গত বছরে সেই লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৫ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু ক্রেগের আক্ষেপ, মার্কিন প্রশাসন চেষ্টা করা সত্ত্বেও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-সম্পর্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের তরফে এখনও ঘাটতি থেকে গিয়েছে। ক্রেগের কথায়, ‘‘মার্কিন ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট উৎসাহী এখানে বিনিয়োগ করতে। মার্কিন সরকার চেষ্টাও করছে। কিন্তু এখানে অনেক বাধা রয়েছে।’’
কিন্তু বাধা থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে উষ্ণতা রয়েছে, তাতে কোনও প্রভাব প়ড়বে না বলেই বিশ্বাস ক্রেগের। মিষ্টি দই, গুলাব জামুনের ভক্ত কনসাল জেনারেলের কথায়, ‘‘এ দেশ থেকে প্রচুর পড়ুয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন। আমার বিশ্বাস, এ দেশে আমার যা অভিজ্ঞতা, তাঁদেরও সেই একই অভিজ্ঞতা সেখানে।’’
এ শহর থেকে যদি কিছু নিয়ে যেতে হয় কী নেবেন? একটু থমকালেন ক্রেগ। বললেন, ‘‘আমার আঁকা। এ শহর আমাকে আঁকতে শিখিয়েছে।’’ মিরইয়াং সম্মতি দিলেন একটু হেসে।
এ শহর, শহরের মানুষের স্মৃতি, সম্পর্ক, শহরের রং— প্যাকিংয়ের বাইরে এই সব, সমস্ত কিছু এখান থেকে নিয়ে যেতে চান হল-দম্পতি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy