Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কলকাতার কড়চা

জীবনসংগ্রামে অপরিমেয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উত্তমকুমার তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল— আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ। বাংলার সেই মহানায়কই ১৯৪৮ সালের ১ জুন গৌরীরানির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

চিত্রাবলিতে ফিরে এলেন উত্তমকুমার

জীবনসংগ্রামে অপরিমেয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উত্তমকুমার তাঁর লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল— আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ। বাংলার সেই মহানায়কই ১৯৪৮ সালের ১ জুন গৌরীরানির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। অবশ্য তখনও তিনি ‘মহানায়ক’ হননি। বিবাহবাসরে বরবেশী উত্তম সত্য চৌধুরীর গাওয়া জনপ্রিয় গান ‘পৃথিবী আমারে চায়/রেখো না বেঁধে আমায়’ নিজ কণ্ঠে গেয়ে আসর মাত করলেন। পরে তিনি এই নামের সিনেমাও করেছেন। এ বার এই নাম নিয়েই পরিমল রায় ও কাজি অনির্বাণ নিবেদিত মহানায়কের চিত্রজীবনী পৃথিবী আমারে চায় প্রকাশ পাচ্ছে (দ্য কালার্স অব আর্ট, পরি: বিংশ শতাব্দী)। মহানায়কের বর্ণময় অভিনয় জীবনের স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল সামাজিক চেতনার অভাবে আগেই হারিয়ে গিয়েছে, সেটা অগণিত সংগ্রাহক এবং বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফির গবেষকরা বর্তমানে বেশ ভাল করেই অনুভব করছেন। তারই মধ্যে ছড়িয়েছিটিয়ে যতটুকু ছিল, সেগুলোকেই চার বছর ধরে ‘একঘাটে’ করার প্রয়াস এই বইয়ে। বইটিতে উত্তম-অভিনীত ছায়াছবিগুলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনসংযোগ শিল্পের নানান উপাদান, যেমন পোস্টার, লবিকার্ড, প্রচারপুস্তিকা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ছাড়াও সংকলিত হয়েছে তাঁর অভিনীত ছায়াছবির নায়িকাদের আলোকচিত্র, তাঁর সহযোগী ও সহযাত্রী বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আলোকচিত্র, এমনকী যে সব প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পীরা উত্তমকুমারের লিপ-এ গান গেয়েছেন তাঁদেরও আলোকচিত্র রয়েছে।

সঙ্গে তাঁর অভিনীত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের পূর্ণাঙ্গ তালিকা, ছায়াছবির গানের রেকর্ডের কভার, ‘চিড়িয়াখানা’ ছায়াছবির আংশিক চিত্রনাট্য, সিনেমা পত্রিকার প্রচ্ছদ, ডাকটিকিটে উত্তম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সন্দীপ রায়ের উত্তম সম্পর্কিত দুটি ভিন্ন স্বাদের লেখা। এমনকী ৫১ আহিরিটোলা স্ট্রিটে তাঁর মাতুলালয়ে আঁতুরঘরের ছবি থেকে শুরু করে শ্মশানযাত্রার ছবিও সযত্নে ছাপা হয়েছে সাড়ে পাঁচশো পাতার বইটিতে। বাংলাদেশের তারিক আহমেদ-এর সৌজন্যে বইটির প্রকাশনা সম্ভব হয়েছে। সঙ্গে মাঝে বইটির প্রচ্ছদ, ডান দিকে ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার।

বিশেষ সন্দেশ

দুর্ধর্ষ দুশমন। ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় ট্রেনের কামরায় প্রথম পরিচয়ের পরেই জটায়ু তাঁর উপন্যাসটি তুলে দিয়েছিলেন তোপসের হাতে। বইটির প্রচ্ছদটিও এক ঝলক দেখেছিলাম আমরা। ময়ূখ চৌধুরী এবং সত্যজিৎ রায়ের যৌথ প্রয়াসের ফসল সেই চমৎকার প্রচ্ছদটি এ বার ফেলুদাপ্রেমীদের উপহার দিচ্ছে সন্দেশ (সম্পা. সন্দীপ রায়)। ২০১৭ বইমেলা সংখ্যা সন্দেশের বিশেষ আকর্ষণ ‘সোনার কেল্লা’। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা সোনার কেল্লার শেষ টাইটেল কার্ডটি রয়েছে প্রচ্ছদে। রয়েছে আরও দুটি পুরো পাতা রঙিন ছবি। রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী লিখেছেন শুটিং-এর কিছু মজার এবং মনকাড়া ঘটনা। প্রসাদরঞ্জন রায় এবং রাকা দাশগুপ্ত সোনার কেল্লার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন দুটি সরস প্রবন্ধ। টুকরো খবর শুনিয়েছেন সুগত রায় ও স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়াও এই সংখ্যায় রয়েছে ন’টি বিভিন্ন স্বাদের গল্প।

স্মরণ

‘কলকাতাকে নিছক ধনকুবেরদের আনন্দলোক ভাবতে খাপছাড়া লাগে। গরিব, মাঝারি অবস্থার লোকদের জায়গা দিয়েও কলকাতা পরিচ্ছন্ন সুন্দর হতে পারে।’ এমন বাক্য তো বটেই, ‘পশ্চিমবঙ্গের হালহকিকত’ নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধে অশোক সেন লিখছেন ‘কর্মসংস্থানের সমস্যা বড়ই ভয়ঙ্কর।... অসংগঠিত শিল্প, স্বনিযুক্তি প্রকল্প, শ্রমনিবিড় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রয়োজন খুব বেশি।’ এমনই তাঁর আরও অগ্রন্থিত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আলোচনা চক্র-এর ‘অশোক সেন স্মরণ সংখ্যা’-য়। আছে তাঁর আত্মকথা-ও। তাঁকে নিয়ে বিশিষ্ট জনের স্মৃতিচারণের সঙ্গে তাঁর মনন নিয়েও আলোচনা, যেমন দীপেশ চক্রবর্তী: ‘উনিই অগ্রসর-ভাবুক ও তাত্ত্বিক... আমাদের ভূমিকাই ছিল শেখার।’ শুরুতেই অবশ্য প্রকাশক চিরঞ্জীব শূর খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন তাঁর ‘চিন্তা ও ইশারাগুলোর উত্তরাধিকার তথা দেশকালের প্রতি তাঁর দায়ের আরব্ধ কর্মসূচির ধারাবাহিকতা’র কথা। আর তাঁর গ্রন্থাদি ও রচনাপঞ্জির সংকলন করেছেন রুশতী সেন।

স্বপনবুড়ো

বাংলা শিশু-সাহিত্যের জগতে অখিলবন্ধু নিয়োগী (১৯০২-১৯৯৩) ‘স্বপনবুড়ো’ নামেই পরিচিত। তিনি বাঙালি শিশুর আনন্দযজ্ঞের পুরোহিত, তাদের উৎসবের নায়ক ও সহচর। শুধু শিশু-সাহিত্য সৃষ্টিতেই নয়, শিশুমেলার সংগঠনে তিনি কচি মনের অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠিটিও আয়ত্ত করেছিলেন। ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইলের সাঁকরাইল গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। কলকাতায় স্কটিশ চার্চ স্কুল ও সিটি কলেজে পড়েছেন। বেশ কিছু দিন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে ও চিত্র পরিচালনার কাজও করেন। সিনেমার জন্য গান লিখেছেন। ছোটদের জন্য তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন। এ বার প্রকাশিত হল স্বপনবুড়ো রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড (সম্পা: নিমাই গরাই, লালমাটি)। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘বেপরোয়া’, ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’ বা ‘হীরের আংটি’, ‘ঠাকুরদার হুঁকো’, ‘কঞ্জুসের লণ্ঠন’-এর মতো গল্পও জায়গা পেয়েছে বইটিতে।

পরিযায়ী

ভ্রমণ সাহিত্যের জগতে দুঃসংবাদ! সতেরো বছর ধরে ভ্রমণচিন্তায় সাড়া জাগানো দ্বিমাসিক পত্রিকা যারা পরিযায়ী বন্ধ হয়ে গেল। সম্প্রতি প্রকাশিত হল পত্রিকাটির ‘শেষ সংখ্যা’। ‘প্রতি সংখ্যাতেই নতুন নতুন চমক থাকত। দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন জায়গার বন্যপ্রাণী, মানুষ নিয়ে বিভিন্ন লেখা অতি মনমুগ্ধকর ও শিক্ষণীয় বটে।’ স্মৃতিচারণ করেছেন বুদ্ধদেব গুহ। এ বারের সংখ্যাতে লিখেছেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, বরুণ দত্ত, দীপঙ্কর ঘোষ, সুপ্রিয় কর, লোপামুদ্রা তালুকদার, রত্না ভট্টাচার্য প্রমুখ। সঙ্গে আছে সতেরো বছরে প্রকাশিত প্রচ্ছদ সংবলিত একটি পোস্টারও। এবং পত্রিকা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন শুদ্ধব্রত দেব, যুধাজিৎ দাশগুপ্ত, রথীন চক্রবর্তী, দেবাশীষ দেব প্রমুখ। সোমনাথ ঘোষের উচ্চারণ বহু পাঠকেরই মনের কথা, ‘শুনেছি পরিযায়ী পাখিরা আবার ফিরে আসে তাদের পুরনো জায়গায়।’

প্রয়াণ

‘কলকাতা শহরে মুষ্টিমেয় যে কয়েক জনকে দেখে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করার অনুপ্রেরণা পেতাম, অমিতাভ বসু ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।’ বললেন সুগত মারজিৎ। অধ্যাপক বসুর সম্মানে প্রকাশিত বইটি সম্পাদনা করেন তিনিই। ‘কত খ্যাতনামা লোক যে নিজেরা আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সেই বইতে লেখার জন্য, সেটা মনে রাখার মতো।’ বললেন সুগতবাবু। অভিরূপ সরকার জানালেন, ‘এমন সুভদ্র, অভিজাত মানুষ, বাঙালি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে এমন সমান সাবলীল লোক বিরল। অমিতাভদা দুন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, আবার নিজের ভিতরে উত্তর কলকাতার সত্তাটিকেও নষ্ট হতে দেননি। প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ ছিলেন তিনি।’ আই আই এম কলকাতায় দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা করেছেন, প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশকও ছিলেন টানা পাঁচ বছর। ১৩ জানুয়ারি ৬৯ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন অমিতাভ বসু। সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সায়েন্সেস-এর বোর্ড অব গভর্নর্স-এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি, আজ বিকেল সাড়ে চারটেয় সেন্টারের পাটুলি ক্যাম্পাসে তাঁর স্মরণসভা। ৩১ জানুয়ারি আই আই এম-এর স্মরণসভা জোকা ক্যাম্পাসে।

প্রথম সত্যজিৎ

বাঁ দিকের কোণে পাগ্‌লা দাশু-র চোখ মটকানো, মুখে ফিচেল হাসি, লেখকের নাম সুকুমার রায়চৌধুরী, প্রকাশক এম সি সরকার। সেই প্রথম প্রচ্ছদ সত্যজিৎ রায়ের। ১৯৭০-এ সন্দেশ-এর একটি সংখ্যায় তাঁর প্রথম কমিকস... দোকান থেকে নতুন ছাতা কিনে বেরনো এক বাবু বাঙালির প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তার জমা জলে কী নাজেহাল অবস্থা। ১৯৬১-র মে-তে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিজের যুগ্ম সম্পাদনায় বেরনো নতুন পর্যায়ের সন্দেশ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদও সত্যজিতের। তাতেই লিয়র-অবলম্বনে তাঁর প্রথম অনুবাদ-কবিতা ‘পাপাঙ্গুল’: ‘নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল— পাপাঙ্গুল!’ এই রকমই তাঁর করা প্রথম ফিল্ম বুকলেট-পোস্টার, নাটকের ফোল্ডার, হেডপিস ইত্যাদির সঙ্গে তাঁর লেখা প্রথম গল্প, গান, প্রবন্ধ, রূপকথা, শঙ্কু-ফেলুদা-মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প, মৌলিক চিত্রনাট্য— সব কিছু নিয়ে বেরল প্রথম সত্যজিৎ (নিউ স্ক্রিপ্ট)। এ বইয়ের প্রথম থেকে শেষ অবধি উলটোলে টের পাওয়া যায় সত্যজিতের প্রতিভা কতটা বহুমুখী! ‘বাবার কর্মময় জীবনের পাঁচ দশকেরও বেশি ইতিহাস ধরা আছে এই বইটিতে।’ জানিয়েছেন বইটির সম্পাদক সন্দীপ রায়।

আদানপ্রদান

এশিয়া কেন্দ্রিক ভাবনা এখন নতুন করে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের উপরে এক কালে যে প্রভাব ছিল ভারতের, এ প্রসঙ্গে তা ফিরে দেখা প্রয়োজন। সম্প্রতি আইসিসিআর-এ ‘ফ্রিড’ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বিশেষজ্ঞদের কথায় উঠে এল সেই মতামত। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নিয়ে গবেষণায় যুক্ত বিশিষ্টজনের সঙ্গে আলোচনায় ছিলেন নেপাল, তাইল্যান্ড এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্তারাও। সুগত বসু বললেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান যাত্রার কথা। দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন কবি, তা ফুটে ওঠে সে সময়কার লেখায়। এই সম্পর্ক যে বহুমুখী সে কথা মনে করিয়ে দেন জহর সরকার। বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতিতেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে আশপাশের দেশগুলি।

পরম্পরা

দুশো বছর পেরিয়েছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’একটা পাওয়া গেলেও শিক্ষক তালিকায় ডিরোজিয়ো-রিচার্ডসন থেকে রসময় মিত্র হয়ে কানাইলাল মুখোপাধ্যায়, কিংবা ছাত্র তালিকায় মধুসূদন ভূদেব রাজনারায়ণ প্যারীচাঁদ থেকে সত্যেন বসু রাধারমণ মিত্র প্রণব বর্ধন, এক দিকে উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎবৃন্দ অন্য দিকে বিশ শতকে জীবনের বহু বিচিত্র ধারায় সফল অনেকানেক ব্যক্তিত্ব— এমন সম্মিলন দ্বিতীয়রহিত বলাই চলে। হিন্দু কলেজ আর তার পরম্পরায় হিন্দু স্কুল এমনই এক প্রতিষ্ঠান। সদ্য সমাপ্ত দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে স্মারকগ্রন্থ হিন্দু কলেজ থেকে হিন্দু স্কুল (দ্বিশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন কমিটি ও দে’জ)। প্রায় পাঁচশো পাতার এই সংকলনে ধারাবাহিক ইতিহাসের বহু নথির সঙ্গে আছে দুর্লভ দেড়শতাধিক ছবি। শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিবৃত্ত নয়, বাংলার ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের মহার্ঘ দলিল।

চিকিৎসাকোষ

বাংলা ভাষায় কোষগ্রন্থ একাধিক থাকলেও চিকিৎসা বিষয়ে বিশ্বকোষ প্রকাশের উদ্যোগ তেমন নজরে পড়ে না। এত দিনে ডা. নৃপেন ভৌমিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল চিকিৎসাবিজ্ঞানকোষ (আনন্দ)। অচিকিৎসক সাধারণ পাঠকের অনেক ভুল ধারণা যেমন এই বই পড়ে কাটবে, ছাত্রছাত্রী ও পরা-চিকিৎসাকর্মীদেরও কাজে লাগবে এই মহাগ্রন্থ। বাংলা পরিভাষাকে এ ভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ প্রশংসনীয় তো বটেই, আর তার সঙ্গে চিকিৎসকরাও যদি রোগীদের বাংলায় বোঝানর জন্য একটু এর পাতা উল্টে দেখেন....।

উদ্‌যাপন

কালের যাত্রায় বয়স বাড়ে প্রতিষ্ঠানের। সেই পথ চলা ছাপ ফেলে যায় ব্যক্তি ও সমাজজীবনে। ২০১৫ সালেই ১২৫ বছর পূর্ণ করেছিল ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তার উদ্‌যাপনও হয়েছে। এ বার সেই উপলক্ষে প্রকাশিত হবে স্মারকগ্রন্থ শ্রদ্ধয়া-তপসা-সেবয়া: একটি যাত্রাপথ (১২৫ বর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি ও র‌্যাডিয়ান্স)। রয়েছে বাংলার নবজাগরণ থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারী জাগরণের প্রেক্ষাপট নিয়ে নানা আলোচনা। রয়েছে বিদ্যালয়ের ইতিহাসও। ৩১ জানুয়ারি শিবনাথ শাস্ত্রীর জন্মদিনে বিদ্যালয়ের মেরি কার্পেন্টার হলে গ্রন্থটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। অন্য দিকে, প্রতি বারের মতো এ বারও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ১৮৭তম মাঘোৎসবের আয়োজন করেছিল। গণেশপ্রতাপ সিংহের চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন হয়। ‘ব্রাহ্ম আন্দোলন— সমাজ জীবনে তার প্রতিফলন’ বিষয়ে আলোচনা করেন জহর সরকার ও সুদিন চট্টোপাধ্যায়।

পত্রালাপ

‘বেশি ঠেকে পড়েছি... এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার; দয়া করে ব্যবস্থা করুন।’ সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে চিঠিতে লিখছেন জীবনানন্দ দাশ। চিঠিতে জানাচ্ছেন ঋণশোধের উপায়ও, কবিতা লিখে হবে না, প্রবন্ধ লিখবেন, বা উপন্যাস, ছদ্মনামে। বরিশালে অধ্যাপনাকালে রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘আমি একজন বাঙালী যুবক; তারপর ভিড়ের ভিতর হারিয়ে গেছি।’ বিভিন্ন জনকে লেখা জীবনানন্দ দাশের মোট ১১৭টি চিঠির সংকলন পত্রালাপ (এবং মুশায়েরা)। সম্পাদনা ও ভূমিকায় কবির জীবনীকার প্রভাতকুমার দাস, প্রতিটি চিঠির সঙ্গে যোগ করেছেন টীকা ও প্রাসঙ্গিক তথ্য। অধিকাংশ চিঠিই সংক্ষিপ্ত, পোস্টকার্ডে লেখা, মূলত প্রত্যুত্তর হিসেবে, যদিও তাতে জীবনানন্দের মানসিক পরিস্থিতি বিধৃত। পরিচিত জনের কাছে কাজের খোঁজ, বন্ধুতার আকুল আগ্রহ, তরুণ কবিকে পরামর্শ— মানুষ ও লেখক জীবনানন্দের এ এক আশ্চর্য পরিচয়লিপি।

আমলার মন

আমরা প্রশাসনিক সংস্কার চাই, কিন্তু প্রশাসনের মনের খবর নিই না। একটা ছাড়া অন্যটা হয় না। যাঁদের বলি আমলা, তাঁদের মনকে না বুঝলে কাজ করাব কেমন করে?— প্রশাসন যাঁরা চালান, তাঁদের মানসিকতা বুঝতে চেয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন দশকের অভিজ্ঞতা এবং মনোযোগী পঠনপাঠনের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধগুলি। সেগুলি দুই মলাটে গ্রন্থিত হল এ বার: আমলার মন (দে’জ)। প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘আমলা শব্দটাকে এবার নির্বাসনে পাঠাতে হবে’। শেষ পর্যন্ত পাঠানো গেল না তা হলে? আমলা বলে কথা!

শব্দমেলা

বাংলা শব্দভাণ্ডারে বিবিধ ধ্বন্যাত্মক রতন। মুখের ভাষায় তো বটেই, হুতোম-ঈশ্বর গুপ্ত-রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়ে একালের লেখক-কলমেও তাদের অফুরান প্রাণ। দুমদাম ঠাসঠাস থেকে রুমঝুম কটমট, প্রয়োগই বলে দেয়, অর্থ না থাকলেই শব্দেরা নিতান্ত নিরর্থক নয়। ধ্বনিপ্রধান শব্দেরও আছে বিচিত্র গতিপথ। দরকার ছিল এদের দু’মলাটে ধরবার মতো একটি বই, আশিস খাস্তগীরের বাংলা শব্দমেলা (সোপান) তা সম্ভব করল। ৫০০০ ধ্বন্যাত্মক শব্দের সংকলন ছাড়াও এতে আছে যমজপ্রত্যয় শব্দ, শব্দদ্বিত্ব, রূপক শব্দ, সংখ্যাশব্দের মেলা। আর এই সব কিছুই গম্ভীর ক্লাসরুম-কেতায় নয়, গল্পের ছলে রসে-কবিতায় তুলে ধরা।

পুরাণকোষ

এই পৃথিবীতে কম্পন, ভূকম্পন অহরহ। কিন্তু অকম্পন ঠিক কে? নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত, সদ্য প্রকাশিত পুরাণকোষ (সাহিত্য সংসদ) থেকে জানা গেল, অকম্পন আসলে তিন জন। এক জন মৎস্যপুরাণ অনুসারে হিরণ্যকশিপুর সভার অসুর, অন্য জন রামায়ণে খর ও দূষণ নামে দুই রাক্ষসের অনুচর। তৃতীয় জন মহাভারত অনুযায়ী সত্যযুগের এক রাজা। নতুন বইটির বৈশিষ্ট্য এখানেই। পৌরাণিকা বা পৌরাণিক অভিধান গোছের সংক্ষিপ্ত ‘হু’জ হু’ নয়। বরং বিভিন্ন আকর ঘেঁটে সব চরিত্রকে পাশাপাশি রেখে দেওয়া। কিন্তু এই জরুরি বইয়ের এটি প্রথম খণ্ড মাত্র (অ থেকে ঔ)। ফলে পরবর্তী খণ্ডগুলির জন্য ধৈর্য ধরা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

যুগলবন্দি

কথা কি শুধু আগুনখেকো বিপ্লবীদের থাকে ? থাকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের কুশলী কর্মীদেরও। সে কথা শুধু রাষ্ট্রের শেখানো কথা নয়, নিজের কথাও। অথচ বিপ্লবের ইতিকথা লেখার সময় সে কথায় আমরা কান দিতে ভুলে যাই। বাংলায় নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা সব উপন্যাসেই পুলিশ পুলিশই, তারা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে বিবেচিত নয়। তাঁদের রাগ-শোক-পরিতাপ অপ্রকাশিত। কুনাল বসুর প্রথম বাংলা উপন্যাস রবি-শংকর (আনন্দ) শুধু একদা নকশাল রবির স্মৃতিকথা নয়, পুলিশ শংকরেরও কথকতা। এই দুই চরিত্রের যুগলবন্দি কুনাল লিখেছেন আপাত নিরাসক্ত ভঙ্গিতে। কোনও পক্ষ যেন নিচ্ছেন না— রাষ্ট্র ও বিপ্লব দুই পক্ষের দুই চরিত্রকে দেখছেন, চিনতে চাইছেন। কুনাল ইংরেজি ভাষার প্রতিষ্ঠিত কথাকার, বাংলাতেও সমান সচল। বাঙালি পাঠকের পক্ষে এ খবর আহ্লাদের।

শতবর্ষে

কিশোর-কিশোরীদের নিজস্ব একটি পত্রিকার জন্য তিনি খুব কম বয়স থেকেই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ, ইংরাজির ১৯৬৮ সালে কিশোর ভারতী-র পুজোসংখ্যার মাধ্যমে। এর পরই তাঁর জাদুকরি লেখনীর উৎসমুখ উৎসারিত হল। পত্রিকার পৃষ্ঠায় একের পর এক লেখা বের হতে থাকল— দুরন্ত ঈগল, নীল ঘূর্ণি, ভালুকবালক ‘ভাবা’ সিরিজ, কালের জয়ডঙ্কা বাজে, কিংমিক ও নানুকের দেশে প্রভৃতি। তিনি স্বনামে তো বটেই, এমনকী পত্রিকার নানা বিভাগে নানা ছদ্মনামে একাধিক লেখা লিখেছেন। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৯১৭-১৯৯৫) জন্ম বাংলাদেশের নড়াইল জেলার পাইকড়া গ্রামে। বাবা অবনীভূষণ গণিতশিক্ষক, তার সঙ্গে ছিল প্রকাশনার ব্যবসা। দেশভাগের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি সাহিত্যের এম এ ও মার্কসবাদী দীনেশ বাবার প্রকাশনা ব্যবসায় যোগ দেন। কিন্তু তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না কিছুতেই। সাহিত্য সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। ইংরাজিতে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই দেখে লিখে ফেললেন, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি নিয়ে রোমাঞ্চকর গল্পের মোড়কে ভয়ঙ্করের জীবন-কথা। এই বইয়ের জন্য ১৯৬২ সালে পেলেন শিশুসাহিত্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তাঁর জন্মশতবর্ষ শুরু হল এ মাসেই। সারা বছর ধরে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। বইমেলায় প্রকাশিত হল দীনেশচন্দ্র রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড। এস বি আই অডিটোরিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল দীনেশচন্দ্র শতবর্ষ স্মরণ সন্ধ্যা। ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার প্রমুখ।

সর্বজয়া

বোড়াল গ্রামে সেই ভাঙা বাড়িটায় আর যাব না।... কিন্তু ওখানে আমরা যে জীবন গড়ে তুলেছি, তা হারাবে না। যে শিক্ষা ওখানে পেয়েছি তা ভুলব কেমন করে?’ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায়, ১৯৫৫-য়, ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর। নিজের জীবনটাকে স্বপ্ন আর সর্বজয়ার জীবনটাকেই সত্যি মনে হত তাঁর। প্রথম ছবির পর সত্যজিতের অপরাজিত, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, বা আরও পরে মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ-তে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় করে রেখেছে তাঁকে। ছবিতে আসার আগেই তিনি মঞ্চাভিনেত্রী... ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে; উৎপল দত্তের নির্দেশনায় ইবসেন-এর গোস্টস বা আ ডলস হাউজ-এ; এমনকী রবীন্দ্রনাথের চিরকুমার সভা আর নষ্টনীড়-এও। একই সঙ্গে ‘ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আত্যন্তিক অনুরাগ, বই পড়া ও লেখালেখির সতত চর্চা ও প্রখর সমাজবোধ’ ছিল তাঁর চরিত্রগত, জানিয়েছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। শমীক ও সুদেষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘পথের পাঁচালী’ চিত্ররূপের ষাট বছর পূর্তির বিশ্বব্যাপী উদ্‌যাপনে থীমা থেকে দু’ খণ্ডে প্রস্তুত হয়েছে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমগ্র। সর্বজয়াচরিত্র ১-এ তাঁর চলচ্চিত্র সংক্রান্ত লেখালেখি, গল্প, অনুবাদ, আত্মস্মৃতি। সর্বজয়াচরিত্র ২-এ অপ্রকাশিত অসমাপ্ত লেখা, দিনলিপি, পত্রগুচ্ছ। দু’ খণ্ডেই দুর্লভ সব আলোকচিত্র।

গ্রন্থরসিক

বই হাতে পেয়ে লেখা নিয়েই পাঠক ভাবেন, প্রচ্ছদ বা অলংকরণ নিয়েও হয়তো কিছুটা ভাবেন, কিন্তু বাঁধাই নিয়ে ভাবেন এমন গ্রন্থরসিক নগণ্য। অথচ একটি ভাল বইয়ের আয়ু প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে বাঁধাইয়ের ওপর। ধন্যবাদহীন এই কাজটি যাঁরা করেন, তাঁদের নাম বইয়ে থাকে না। পি লাল অবশ্য তাঁর রাইটার্স ওয়ার্কশপের বইয়ে বাঁধাইশিল্পী তুলামিঞা মহিউদ্দিনকে অমরত্ব দিয়েছেন, কিন্তু সেটা নেহাতই ব্যতিক্রম। তবে নাম না থাকলেও চোখ থাকলেই চেনা যায় এমন কাজই করেন নারায়ণচন্দ্র চক্রবর্তী। গত অর্ধশতক জুড়ে তিনি এই কাজে যুক্ত। ১৯৬৭-তে ‘চেম্বার্স টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ডিকশনারি’র বাঁধাই কাজ তাঁর জীবনের প্রথম মাইল-ফলক। ১৪০৮ পৃষ্ঠার এই অভিধানের মোট ৫০ হাজার কপির প্রতিটি তিনি নিজের হাতে দেখে তবে ছেড়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহের অসংখ্য বই তিনি নিজ হাতে বাঁধিয়েছেন, প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর অনুরোধে রাজভবনেরও বহু বই বাঁধিয়ে দেন। ১৯৭২ থেকে গ্রন্থবাঁধাই নিয়ে লেখালিখি ও বক্তৃতা দেওয়া শুরু। ভারত সরকার আয়োজিত প্রথম বিশ্ব বইমেলায় বক্তৃতা দেন। ভারত সরকারের ‘জার্নাল অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড’-এ তাঁর মোট আটটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দুই বার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। আশি ছুঁয়েছেন এক বছর আগে। কিংবদন্তি এই শিল্পীকে কিছু দিন আগে সম্মাননা জ্ঞাপন করল ‘অহর্নিশ’। ‘১৭৭৮ গ্রন্থচর্চা’য় প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কথা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kolkatar Korcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE