৪ জানুয়ারি, ১৮৬১। প্রকাশিত হল মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য। মুদ্রণের ব্যয়ভার বহন করেছিলেন দিগম্বর মিত্র। কৃতজ্ঞ মধুসূদন এই ‘অভিনব কাব্য-কুসুম’ উৎসর্গ করলেন তাঁকেই। ‘প্রিয় ইন্দ্রজিতের মৃত্যু উদ্যাপন’-এ অমিত্রাক্ষরের উদ্দীপিত শব্দ-রোশনাই সংবর্ধিত করলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ ও বিদ্যোৎসাহিনী সভা। ১২ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্যবাসরে কবির হাতে তুলে দেওয়া হল মানপত্র, রৌপ্য পানপাত্র। স্বামী বিবেকানন্দ এই মহাকাব্যকে বলেছিলেন ‘বাঙলা ভাষার মুকুটমণি’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণ: ‘মধুসূদন দত্ত মহাশয়ের... গলার আওয়াজ ছিল একটু ভাঙ্গা-ভাঙ্গা।...একদিন তিনি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের পাণ্ডুলিপি তাঁহার সেই ভাঙ্গা-ভাঙ্গা গলায় পড়িয়া শুনাইতেছিলেন।…প্রত্যেক কথাটি স্পষ্ট করিয়া, থামিয়া থামিয়া এবং পৃথক পৃথক করিয়া, একটানে বলিয়া যাইতেন।’ গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে গৌতম হালদার, বাংলার মঞ্চে এই মহাকাব্য নাট্যায়নের ইতিহাসও সুদীর্ঘ। দক্ষিণ কলকাতার এক মাংস বিক্রেতা আজও অনর্গল আবৃত্তি করেন এই মহাকাব্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের হীরকখণ্ডটি আবির্ভাবের আজ ১৬০ বছর শুরু। ছবিতে অতুল বসুর তুলিতে মধু-কবি।
স্মরণে জেগে
আধুনিক বাঙালি সমাজজীবন যদি বা ভোলে, সমাজমাধ্যম ভোলে না। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের জন্মদিন, প্রয়াণদিন বা বিশেষ উপলক্ষের উদ্যাপনে সমাজমাধ্যমে ভেসে ওঠে না-জানা তথ্য, ছবির মণিকণা। ১ জানুয়ারি ছিল আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিন, নতুন বছরের প্রথম দিনে শুভেচ্ছাবার্তার সঙ্গে সমাজমাধ্যম ভরে ছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানীর জীবনকৃতি স্মরণে। রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের সংযোগ, তাঁর বিজ্ঞান ও শিল্পজীবন, শিক্ষক ও প্রশাসক সত্তা বাঙালি ভোলেনি, বোঝা গেল অনুপম অনুভবে। হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যাপনও— সত্যেন্দ্রনাথ বসুরই প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ ভবনে আচার্যের মূর্তিতে মাল্যদান, পরে তাঁর জীবন ও গবেষণা, বাংলায় বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা। জানা গেল বিজ্ঞানীর অপ্রকাশিত চিঠি, লেখা, ছবি-সহ তাঁর রচনা সঙ্কলনের নতুন সংস্করণ প্রকাশের পরিকল্পনাও।
শূন্যের অভিযাত্রা
শূন্যের আবিষ্কার প্রাচীন ভারতে। গবেষণাগারে তৈরি হয়নি, মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায়নি। তা হলে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয় নরেন্দ্রপুরের (স্বশাসিত) গণিত বিভাগ কলেজের ষাট বছর পূর্তিতে তৈরি করছে ‘জ়িরো গ্যালারি’। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ঘেঁটে ওঁরা তুলে এনেছেন প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে প্রচলিত সংখ্যা গণনাপদ্ধতি, যার কোথাও কোথাও শূন্যের ধারণা ছিল। মিশরের চিত্রলিপি, পেরুর ইনকাদের গিঁট বাঁধা দড়ির ‘কিপু’, ব্যাবিলনীয় পোড়ামাটিতে খোদিত লিপি, মেক্সিকোর মায়া সভ্যতার পাথুরে লিপি, গ্রিক প্যাপিরাস, রোমের সংখ্যাচিহ্ন, চিনে ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চির অদ্ভুত সংখ্যাপদ্ধতি থেকে ভারতীয় সভ্যতার দার্শনিক উপলব্ধি, গ্যালারিতে থাকবে সবই। ভারত থেকেই শূন্যের ধারণা পৌঁছেছিল বাগদাদে, রাজপণ্ডিতদের হাতে অনূদিত হয়ে টিকে গিয়েছিল শূন্য-সহ দশমিক সংখ্যাতন্ত্র, ইউরোপীয় নবজাগরণের গোড়ার দিকে যা ফের ল্যাটিনে অনূদিত হয়। খটোমটো রোমান সংখ্যাতন্ত্রে আটকে থাকা ইউরোপে, প্রাচীন ভারতীয় গণিতজ্ঞদের এই অবদান সময়মতো না পৌঁছলে জ্ঞানচর্চার অগ্রগতি থমকে যেত আরও। প্রকল্পের সঙ্গী কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়াম।
উদার অভ্যুদয়
আন্তোনিন আর্তো-র নাট্য ও আত্মদর্শন নিয়ে গভীর বিশ্লেষণী প্রবন্ধ ব্রাত্য বসুর। তাঁর মতে ‘আর্তোর নাট্যক্রম ছিল একাধারে স্বপ্নপ্রবণ, কালাপাহাড়ী, প্রতিষ্ঠানবিরোধী... আলোড়ন সৃষ্টিকারী।’ বড়দিনে ‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ থেকে প্রকাশ পেল ব্রাত্যজন নাট্যপত্র (প্রধান সম্পাদক: ব্রাত্য বসু)। প্রথাভাঙা নাটকের দুই ব্যক্তিত্ব কমলকুমার ও দীপক মজুমদারকে নিয়ে লিখেছেন অরিন্দম ঘোষ, তাদাশি সুজুকি-র থিয়েটার দর্শন নিয়ে অনুবাদ-নিবন্ধ মৈনাক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাংলা থিয়েটারে অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে জরুরি গোলটেবিল, বলেছেন সৌমিত্র মিত্র, বিলু দত্ত, বিজয় মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী। স্যাস নাট্যপত্র-এর সম্পাদকীয়তে সত্য ভাদুড়ির আশঙ্কা, শিল্প বা শিল্পজনিত মুক্তচিন্তা বা বক্তব্যের স্বাধীনতা থাকবে তো? বৈশাখী মার্জিত বা সুরঞ্জনা দাশগুপ্তের ‘আপন কথা’, সন্ধ্যা দে-র ‘স্মৃতিসত্তায় অজিতেশ-কেয়া’র সঙ্গে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রভাতকুমার দাসের স্মরণলেখ। আছে অ্যাবসার্ড থিয়েটার নিয়ে ব্রাত্য বসুর নিবন্ধও।
নাট্যপত্র