Advertisement
E-Paper

একের পর এক ভোট আসে, কার্ড আর হয় না ওঁদের

এই অভিজ্ঞতা সম্বল করেই দিন গুজরান রাসবিহারী গুরুদ্বার-সংলগ্ন ফুটপাতের মালতী মণ্ডল, দূর্বা সরকার, সঞ্জয় মণ্ডল, ললিতা মণ্ডলদের। ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ তাঁদের কাছে নিছক নেতাদের মুখের বক্তৃতা হয়েই থেকে যায়।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫৪
উপেক্ষিত: রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের গুরুদ্বারের ফুটপাতবাসী এই মহিলাদের ভোটার কার্ড নেই। কোনও দিন ভোটও দেননি তাঁরা। নিজস্ব চিত্র

উপেক্ষিত: রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের গুরুদ্বারের ফুটপাতবাসী এই মহিলাদের ভোটার কার্ড নেই। কোনও দিন ভোটও দেননি তাঁরা। নিজস্ব চিত্র

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখা-টেখা গান-কবিতায় হয়। কিন্তু বাস্তবে আকাশ দূরে থাক, মাটিতে ফুটপাতের ঠিকানায় কোনও চিঠি তো আসেই না, এমনকি নাগরিক পরিচয়পত্র জোটাতেও প্রাণপাত হয়!

এই অভিজ্ঞতা সম্বল করেই দিন গুজরান রাসবিহারী গুরুদ্বার-সংলগ্ন ফুটপাতের মালতী মণ্ডল, দূর্বা সরকার, সঞ্জয় মণ্ডল, ললিতা মণ্ডলদের। ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ তাঁদের কাছে নিছক নেতাদের মুখের বক্তৃতা হয়েই থেকে যায়। কলকাতা মহানগরের ফুটপাতেই তাঁদের জন্ম, বড় হওয়া এবং সংসার। ছাদহীন সেই ফুটপাত-বাড়ির কোনও নম্বর থাকে না। সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পপোস্টের নম্বরেই যাতে ভোটার কার্ড মেলে, সে জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে আবেদন করেন ওই ফুটপাতের গোটা তিরিশ পরিবারের প্রায় ৬০ জন মানুষ। সেই ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেখা— ‘কেএমসি, জোন-থ্রি, ওয়ার্ড-৮৩, পিবি।’ কিন্তু আবেদন পত্রপাঠ নাকচ হয়ে যায়। এক বার নয়, বারবার।

দূর্বা-মালতী-ললিতাদের মতো অনেকের কোনও ভোটার কার্ড হয়নি। জীবনে কোনও দিন তাঁরা ভোট দেননি। এক-এক বার গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞ হয়, চার দিকে কত প্রচার, ভোটপ্রার্থনা দেখেন ওঁরা। সবাইকে ভোট দিতে দেখেন, আর তার পরেই কেমন একটা ভয় আরও চেপে বসে। ‘‘আমরা যে এ দেশের, তারই তো কোনও কাগজপত্র নেই। শুধু ছেলেমেয়েগুলোর জন্মের কাগজ আছে। যে কোনও দিন ঘাড় ধরে বার করে দিতে পারে এখান থেকে। তখন কী করব?’’—দিশাহীন চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলছিলেন মালতী।

ফুটপাত জুড়ে ছড়ানো-ছেটানো গৃহস্থালি। এক পাশে ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে বাচ্চারা। উনুনে মুরগির ছাঁটের ঝোল ফুটছে। সেখানেই জড়ো হয়ে নিজেদের কথা শোনাচ্ছিলেন ঠিকানাহীন মানুষগুলো। মালতীর কথায়, ‘‘বাপ-ঠাকুর্দারা সুন্দরবনের সন্দেশখালি থেকে চলে এসেছিলেন। আমাদের জম্ম-কম্ম এই কলকাতার ফুটপাতেই। কাগজ কুড়ানো আর লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ। কোথা থেকে আমাদের কাগজপত্র থাকবে?’’ তার পরে বলেই ফেললেন, ‘‘কাছেই তো দিদি-র বাড়ি। কত বার গেলাম। ওখানে লোকেরা খুব ভাল ব্যবহার করে, কিন্তু আমাদের ভোটার কার্ড আর হয় না। জানি, সকলে এ কথা জানলে কুরুক্ষেত্র বাধবে। কিন্তু আর ভয় পাই না। ঠিকানার জন্য কাউন্সিলরের সই দরকার। আমরা ফুটপাতে থাকি শুনে মঞ্জুশ্রীদি সই দিল না। সার্ভে বিল্ডিংয়ে সবাই মিলে তিন বার কাগজপত্র জমা দিলাম। বাতিল করে দিল।’’

মালতী জানান, সব দিকে ধাক্কা খেয়ে মাসখানেক আগে এজেন্ট ধরে ১০০০ টাকা দিয়ে আধার কার্ড করিয়েছেন। তার জন্য দু’টো কাগজে স্থানীয় বিধায়কের সই আনতে এজেন্ট বাড়তি ৬০০ টাকা নিয়েছে। কার্ডে ঠিকানা দিয়েছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, গুরুদ্বার। এ বার সেই কার্ড দেখিয়ে ভোটার কার্ড করানোর চেষ্টা করবেন।

খুন্তি নাড়তে নাড়তে ললিতাও বলে দেন, ‘‘বাপ-মা এসেছিল সুন্দরবনের চোরাবিদ্যা গ্রাম থেকে। আমি এখানেই জন্মালাম। কিন্তু এত বয়স পর্যন্ত কোনও দিন ভোট কেমন ভাবে দেয়, জানা হল না। খুব ইচ্ছে করে ভোট দিতে। ভীষণ দুঃখ হয় ভোটের দিন। আসলে কেউ তো আমাদের এ দেশের লোক মনে করে না। তাই পুলিশ এসে যখন-তখন হাঁকিয়ে দিতে পারে। আর পা ব্যথা করে সব দলের মিছিল-মিটিংয়ে গেলেও ভোটার কার্ড জোটে না আমাদের।’’

দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তরে গিয়ে বাগবাজার খাল লাগোয়া ফুটপাতে দেখা হল সরস্বতী, রঞ্জিত আর মামণি মণ্ডলের সঙ্গে। সরস্বতীর বয়স ৩৬, মামণির ৪৫। দু’জনে এ বার প্রথম ভোট দেবেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ৬-৭ মাস আগে তাঁদের ভোটার কার্ড হয়েছে। এখানেও বাধা হয়েছিল সেই ঠিকানা, সেই কাউন্সিলরদের সই না-পাওয়া। শেষ পর্যন্ত একই ফুটপাতে পাশাপাশি থেকে এক জন কার্ড পেয়েছেন প্রাণকৃষ্ণ মুখার্জি রোডের ঠিকানায়, অন্য জন বঙ্গ লেনের ঠিকানায়। মামণি বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম কোনও দিন ভোট দিতে পারব না। সবাই ভয় দেখাত এই বলে যে, আমাদের বাংলাদেশি বলে দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে। বছর তিনেক রান্না-খাওয়া মাথায় তুলে শুধু সবার দোরে দোরে ছুটেছি এই কার্ড করাতে। শেষে ঠাকুরমা হয়ে প্রথম বার ভোট দেব।’’

পরিচয়পত্রের অভাব এবং ঠিকানার জন্যই যে ফুটপাতবাসীদের ভোটার কার্ড তৈরিতে সমস্যা হচ্ছে, মেনে নিয়েছেন

একাধিক কাউন্সিলরও। ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মঞ্জুশ্রী মজুমদার বললেন, ‘‘আমার এলাকায় অসংখ্য ফুটপাতবাসী। তাঁদের অধিকাংশের কোনও কাগজপত্র নেই, ঠিকানা নেই। কী ভাবে আমি তাঁদের বৈধ অধিবাসী বলে সুপারিশ করে চিঠি দিতে পারি? যাঁরা এমন অনুমোদন নিয়ে আসেন, তাঁদের আমি স্পষ্ট বলে দিই ‘হবে না’।’’ কাশীপুর অঞ্চলের কাউন্সিলর সুমন সিংহেরও বক্তব্য, ‘‘কাগজপত্র, ঠিকানা, পরিচয়পত্র ছাড়া কে এখানকার, কে বাংলাদেশের, কে অপরাধী— কী করে বুঝব? সই করাতে এলে তাই সব সময় তা দেওয়া সম্ভব হয় না।’’

ঠিকানা ফুটপাতের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের ছাড়পত্র হাতে পাওয়ার অপেক্ষা তাই ক্রমেই

দীর্ঘতর হয়।

Lok Sabha Election 2019 Footpath Voter Card
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy