Advertisement
E-Paper

রাজনীতির রঙেই কি অচেনা ‘ঘরের ছেলে’ রাম

এমনিতে ‘ভূতের মুখে রামনাম’ প্রবাদটির বয়স কত, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না শিক্ষাবিদদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, এটা মূলত গ্রামীণ প্রবাদ।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৯ ০১:০০

এক ‘রাম’ ঘরের ছেলে। আর এক ‘রাম’-ও কি ততটাই ঘরের? না কি সে শুধুই রাজনীতির নির্মাণ? আপাতত তা নিয়েই আলোচনা শুরু হয়েছে বিদ্বজ্জনেদের একাংশের মধ্যে। এক রাম হল ‘ভূতের মুখে রামনাম’-এর রাম! আর এক রাম হল ‘জয় শ্রীরাম’-এর রাম। কারণ, যে বাংলা ‘ভূতের মুখে রামনাম’ শুনতে অভ্যস্ত, সেই বাংলাতেই এখন শুধু রাজনৈতিক মিছিলেই নয়, দৈনন্দিন কথাতেও ‘জয় শ্রীরাম’ অনায়াসে চলে আসছে। তাই আম-বাঙালির কাছে ‘রাম’ শব্দটির অর্থ বা ‘রাম’-এর ধারণা পাল্টে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী জানাচ্ছেন, বৈষ্ণবেরা যেমন ‘জয় নিতাই’ বা শাক্তেরা যেমন ‘জয় মা কালী’ বলেন, তেমনই হিন্দি বলয়ে সাধুরা বলেন ‘জয় সিয়ারাম’। তাঁর কথায়, ‘‘বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে সেটাই কিন্তু জয় শ্রীরাম হয়ে গিয়েছে। অথচ, এই জয় শ্রীরামের সঙ্গে পুরাণের রামের, এমনকি, তুলসীদাসের রামেরও কোনও মিল নেই!’’ কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘এই রাম ধ্বনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়ানো হচ্ছে। ভূতের মুখে রামনাম ছিল নিছক প্রবাদ। কিন্তু এই রাম পুরোপুরি রাজনৈতিক।’’

এমনিতে ‘ভূতের মুখে রামনাম’ প্রবাদটির বয়স কত, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না শিক্ষাবিদদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, এটা মূলত গ্রামীণ প্রবাদ। গ্রামে-গঞ্জে আগে রামনাম করলে ভূত বা অশরীরী পালাবে, এমন ধারণা ছিল। অর্থাৎ, রামের সঙ্গে ভূতের শত্রুতা। ভাষাবিদ সুভাষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ভূতের সঙ্গে রামের শত্রুতার সম্পর্ক। সেখানে যদি ভূতের মুখে রামনাম বলা হয়, বুঝতে হবে অবিশ্বাস্য বা অদ্ভুত কোনও ব্যাপার। সাধারণ ভাবে এটাই অর্থ। সেখানে জয় শ্রীরাম একটি ধ্বনি।’’

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার আবার বলছেন, ‘‘এক বার রামনাম করলে ভূত, রাক্ষস পালানো থেকে সর্বপাপ ক্ষয় হয়, এমনই বলতেন আমাদের মায়েরা। সেখানে জয় শ্রীরাম একদমই আলাদা। উত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে জয় সিয়ারাম বা জয় সীতারাম বলা হয়। সেটাই জয় শ্রীরাম হয়েছে।’’

এর পিছনের কারণ হল, শহরে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা বাড়ছে। এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বিদ্বজ্জনেদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, হিন্দিভাষীদের একটা বড় অংশ কর্মসূত্রে এ শহরে থাকেন। ফলে তাঁদের মুখে অন্য শব্দের মতো ‘জয় শ্রীরাম’ও এখন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির সঙ্গে যে হেতু রাজনৈতিক একটি প্রেক্ষিত জড়িয়ে রয়েছে, তাই হয়তো সেটি আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘অল্পবয়সিদের ভাষায় তো ‘অবে ইয়ার’ ঢুকে পড়েছে, অন্য অনেক হিন্দি শব্দের মতোই। কারণ, শহরে হিন্দিভাষীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। একে হিন্দির অনুপ্রবেশ বা আগ্রাসন যা-ই বলা হোক না কেন, সেটা হচ্ছে। কিন্তু ভূতের মুখে রামনাম আর জয় শ্রীরামের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। জয় শ্রীরাম তো বিপজ্জনক ভাবে রাজনৈতিক!’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

‘ভূতের মুখে রামনাম’-এর রাম আসলে ঘরের ছেলে, বলছেন লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। কিন্তু ‘জয় শ্রীরাম’-এর উচ্চকিত ধ্বনিতে একটু অস্বস্তিই হয়, জানাচ্ছেন তিনি। স্মরণজিতের কথায়, ‘‘রামনামের সঙ্গে শান্তিটুকুই যায়। কিন্তু বারবার জয় শ্রীরাম বলে যে ঠিক কী হয়, সেটা বুঝতে পারি না।’’

রাম ঘরের ছেলে হলেও তাঁকে এক সময়ে বাংলা সংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল, বলছেন কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। বিনায়কের কথায়, ‘‘মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য স্বয়ং এক বন্ধনীতে রাম ও কৃষ্ণের মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন। কারণ, বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হল রাম। কিন্তু বামপন্থীরা এক সময়ে তা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছিলেন। অথচ, এখন তাঁদের অনেক বক্তৃতাতেই রামায়ণ, মহাভারতের প্রসঙ্গ আসছে!’’

‘জয় শ্রীরাম’ সম্পর্কে বিনায়কবাবুর বক্তব্য, ওই ধ্বনি বাগধারার একটা আলাদা রূপ মাত্র। যেমন, উত্তর ভারতের লোক হাজার হাজার বছর ধরে ‘জয় রামজি কি’ বলেন। যেমন, বাঙালিরা ভাসানে বলে থাকেন, ‘দুগ্গা মাঈ কি’। এটাও তেমনই একটা ভাষার মিশ্রণ। বাঙালি-অবাঙালি মিশ্রণের ফলেই এটা এসেছে। কিন্তু তার জন্য রামের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই! বিনায়কের কথায়, ‘‘কেউ যদি এখন জয় শ্রীরাম শব্দবন্ধটি রাজনৈতিক লাভের কারণে ব্যবহার করেন, তা হলে সেটা তাঁদের দায়। কিন্তু তাই বলে শব্দটাকে দায়ী করা আমার মতে ভ্রান্ত একটা পদক্ষেপ। কারণ, শব্দের যে মহিমা তা চিরন্তন। শব্দের গায়ে রাজনীতির যে কলুষ লাগে, তা ক্ষণস্থায়ী।’’

Lok Sabha Election 2019 লোকসভা ভোট ২০১৯ Rama রাম Jay Shree Rama
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy