ঘরের এক দিকের দেওয়াল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। চাল উড়ে গিয়ে ঝুলছে কিছুটা দূরে গাছের ডালে। ঘরের সুইচ বোর্ড উপড়ে কলকব্জা ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ছড়িয়ে তুবড়ির খোল, তারাবাতি, চরকির প্যাকেট। আর সেখানেই পোড়া বারুদের গন্ধের মধ্যে দেহাংশ খুঁজে চলেছে পুলিশ! কারণ, মৃতদের মধ্যে এক জনের দেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে দেখা গিয়েছে, সেটি অসম্পূর্ণ। হাত নেই!
মহেশতলার ‘বাজি মহল্লা’য় বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া বাড়িটির এমনই ছবি ছিল মঙ্গলবার। সকালে ধ্বংসস্তূপ থেকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় এই ঘটনায় মৃত, ১৬ বছরের আলো দাসের একটি হাত। দ্রুত সেটি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ততক্ষণে ময়না তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে ৫২ বছরের লিপিকা হাতি এবং তাঁর ছেলে ২৩ বছরের শান্তনুর মৃতদেহের। সোমবার রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে লিপিকার স্বামী ভরত হাতিকে। তাঁকে এ দিন আদালতে তোলা হলে ১৪ দিনের জেল হেফাজত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বেআইনি বাজি কারখানা চালানো, বিস্ফোরক রাখা-সহ একাধিক ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। যদিও ঘটনাস্থল বা তার আশপাশের এলাকা থেকে বাজি বা বাজি তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। বাজেয়াপ্ত হয়নি বাজি তৈরির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশও। উপরন্তু, দগ্ধ বাড়িতে এ দিনও পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে বাজি তৈরির কাজে ব্যবহার হওয়া একাধিক যন্ত্র।
অবশেষ: বিস্ফোরণের পরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বাজি তৈরির সরঞ্জাম। মঙ্গলবার, মহেশতলা থানার পুটখালি এলাকায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
যে মহল্লায় ঘরে ঘরে এমন বিপজ্জনক ভাবে বাজি তৈরির অভিযোগ, সেখানে পৌঁছে রাজ্যের দমকলমন্ত্রী সুজিত বসু বলেন, ‘‘সোমবার থেকেই এই ঘটনায় নজর রেখেছি। তিন জন মারা গিয়েছেন। একটি বাচ্চা মেয়ের মৃত্যুও হয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক। তদন্ত করছি। পুলিশকেও ফরেন্সিক পরীক্ষা করানোর জন্য বলা হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত কী ভাবে এমন ঘটনা ঘটল বা কী পদক্ষেপ করা হবে, কিছুই বলা সম্ভব নয়।’’ যদিও রাত পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ফরেন্সিক আধিকারিকদের কাউকেই দেখা যায়নি। ওই অঞ্চলের বাজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, ‘প্রদেশ আতশবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক সুখদেব নস্কর যদিও বলেন, ‘‘এখানে বাড়িতে বাড়িতে যে এমন বেআইনি বাজি তৈরি হয়, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই বৈঠকে বসছি। বসতি এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও বাজি প্রস্তুতকারীদের সরানো যায় কি না, তা নিয়ে কথা হবে।’’
যদিও স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, এমন ভাবনাচিন্তা অতীতে বহু বার হলেও কিছুই বদলায়নি। সামনে পুজোর মরসুম না থাকলেও বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ঘরে ঘরে বাজি তৈরি চলছে ওই তল্লাটে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা বা নিয়ম মেনে চলা— কোনও কিছুরই বালাই নেই। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, করোনার পরে সরকার কোনও ব্যবসায়ীকেই আর বাজি তৈরির অনুমতি দিচ্ছে না। কিছু ব্যবসায়ী বেঙ্গালুরু গিয়ে সরকার মনোনীত জায়গায় সবুজ বাজি তৈরির কাজ শিখলেও লাইসেন্স পাননি এখনও। ফলে শুধু মহেশতলাই নয়, রাজ্যের যে কোনও জায়গাতেই বাজি তৈরির কাজ বেআইনি।
এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, বাজি বিক্রির অস্থায়ী দোকানগুলির ঝাঁপ বন্ধ। বিকেল পর্যন্ত কয়েকটি পাকা ছাউনির দোকান খোলা থাকলেও সন্ধ্যার পরে সেগুলিও তড়িঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। লোকমুখে ঘুরছে, তুবড়ি তৈরির জন্য নামডাক রয়েছে ধৃত ভরতের। তাঁর তৈরি ছোট তুবড়িতেও নাকি ব্যাপক তেজ। ওই তুবড়ি তৈরির সময়েই বাড়ির লাগোয়া পুকুরে জল আনতে গিয়েছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছেন ভরত। সে সময়ে ঘরে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে চা বানানোর তোড়জোড় করছিলেন স্ত্রী লিপিকা। কাছেই ছিলেন ছেলে শান্তনু। ভরতের ভাগ্নি আলো গিয়েছিল চা পাতা কিনে আনতে। সে ঘরে ঢুকতেই বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার দেহ। শর্ট সার্কিট থেকেই কোনও ভাবে এই বিপত্তি হতে পারে বলে দাবি আলোর ঠাকুরমা মঞ্জু দাসের। তাঁর পাশেই স্থির হয়ে বসে রয়েছেন আলোর মা কৃষ্ণা দাস। প্রিয় পোষ্য ‘সুইটি’কে নিয়ে কাছেই বসে আলোর বোন, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া প্রিয়া। সে শুধু বলে, ‘‘দিদির জন্য সুইটি কিছুই খাচ্ছে না। কোনও চিৎকারও নেই। সকলকে কাঁদতে দেখে ও আজ একদম চুপ।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)