Advertisement
E-Paper

‘মাথার উপরে গাড়ির গুমগুম শব্দেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে’

সেতুর কোনও স্তম্ভের নীচে পানের পিক জমে লাল বা কোনও জোড়ের ফাটল দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে— ভয়ে যেন সে দিকেই পথচারীদের বেশি করে চোখে পড়তে শুরু করেছে।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৫৮
আতঙ্ক: হাওড়া সেতুর নীচে ট্র্যাফিক গার্ডের সামনের এই রাস্তার মতো যে কোনও সেতুর নীচ দিয়েই  যাতায়াত করতে ভয় পাচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

আতঙ্ক: হাওড়া সেতুর নীচে ট্র্যাফিক গার্ডের সামনের এই রাস্তার মতো যে কোনও সেতুর নীচ দিয়েই যাতায়াত করতে ভয় পাচ্ছেন পথচারীরা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

পুলিশ ফাঁড়ির দরজাটা বন্ধ রয়েছে। বাইরে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ পাতা প্লাস্টিকের চেয়ার।

নিরাপদ বলতে, মাথার উপরে ব্রেবোর্ন রোড উড়ালপুল থেকে সামান্য দূরত্বে। বুধবার বিকেলে কর্তব্যরত হাওড়া সেতুর ট্র্যাফিক গার্ডের তরুণ সার্জেন্ট স্বীকার করলেন, ‘‘মিথ্যে বলব না। কাল ফাঁড়ির ঘরটায় কিছু ক্ষণ বসার চেষ্টা করেও অস্থির লাগছিল।’’ সেতুর কোনও স্তম্ভের নীচে পানের পিক জমে লাল বা কোনও জোড়ের ফাটল দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছে— ভয়ে যেন সে দিকেই পথচারীদের বেশি করে চোখে পড়তে শুরু করেছে। ওই উড়ালপুলের নীচে গাড়ি-ট্যাক্সির ভিড় কাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন এক প্রৌঢ়। বললেন, ‘‘মাথার উপরে গাড়ির গুমগুম শব্দেই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।’’

বয়স্ক নাগরিকটির দোষ নেই। হোয়াটসঅ্যাপে জনপ্রিয় রসিকতাতেও চালকের প্রশ্নের জবাবে সওয়ারি জানাচ্ছেন, উড়ালপুলের নীচ দিয়ে না গিয়ে উপরটা ধরাই বরং ভাল! উপরে থাকাকালীন কিছু ঘটলে, তা-ও দেহ সৎকারের আশা রয়েছে। উড়ালপুলের নীচে থাকলে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনকি উড়ালপুলে ওঠার আধ ঘণ্টা বাদেও ফোনে খোঁজ না পেলে গিন্নিকে টিভি-র খবর দেখতে বলা হচ্ছে, যদি তাতে কোনও দুর্ঘটনার খবর মেলে!

আসলে রসিকতার মোড়কে তীব্র আতঙ্কই ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ নাগরিক থেকে বিশিষ্টজনের মধ্যে। মাঝেরহাটের পরে এ বার কোনটা, সেটাও এখন জল্পনার বিষয়! এক সঙ্গীতশিল্পীর ফেসবুক পোস্টের নীচে আর এক শিল্পী, যিনি আবার রাজ্যের শাসক-শিবিরের কাছের লোক (এক বার লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন) লিখেছেন, ‘‘যে কোনও উড়ালপুলে উঠতেই এখন ভয় করছে, বিশেষত ঢাকুরিয়া ব্রিজ!’’

এর আগে প্রায় নতুন উল্টোডাঙা সেতুতে ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলের বিভ্রাটে গোলযোগ ঘটেছিল, পোস্তা উড়ালপুল ছিল নির্মীয়মাণ। কিন্তু পাঁচ দশকের পুরনো মাঝেরহাট সেতুর এই পরিণতি কিছুটা অবিশ্বাস্য ঠেকছে অনেকের কাছেই। একটি নির্মাণ সংস্থার কর্তা রামানুজ সিংহ বলছিলেন, ‘‘যা ঘটল, কোনও উ়ড়ালপুলের নীচে গাড়ি রেখে গিয়েই স্বস্তি পাচ্ছি না। উপরে উঠতেও জড়োসড়ো লাগছে।’’

বিশেষজ্ঞদের পরিভাষায় এই ভয়ের একটা গালভরা নামও রয়েছে। জেফাইরোফোবিয়া! সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই আতঙ্ক জড়িয়ে। সেতু দিয়ে গাড়ি চালানোর সময়ে কারও ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হতে পারে বলে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে আতঙ্কগ্রস্তদের জন্য পুলিশি সাহায্যেরও বন্দোবস্ত আছে। আজকের কলকাতার পরিস্থিতিতেও এমন আতঙ্ক অমূলক বলে মনে করছেন না মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব। তাঁর মতে, ‘‘আমাদের চারপাশে যা দেখছি, তাতে এই আতঙ্ক সাময়িক। টানা কিছু দিন কোনও চালকের হয়ত সেতুর উপরে গাড়ি চালাতে সমস্যা হবে।’’ তা ছাড়া কেউ মানসিক বা শারীরিক ভাবে দুর্বল থাকলে বা তিনি দুর্ঘটনার সাক্ষী হলে, তাঁর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন অনিরুদ্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু এই আতঙ্কের জেরে কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পেলে তাঁর অবশ্যই ডাক্তারি পরামর্শ নেওয়া দরকার।’’

মাঝেরহাটে বিপর্যয়ের রাতে উল্টোডাঙার অটোচালকেরা ওই তল্লাটে উড়ালপুলের নীচে অটো রাখতে ভয় পাচ্ছিলেন। বাইপাসে দেখা গেল, মাথার উপরে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর লাইন থাকলেও কেউ কেউ আতঙ্কিত। জনৈক অ্যাপ-ক্যাব চালকের টিপ্পনী, ‘‘যে শহরে উড়ালপুলের নাম ‘মা’, সেখানে এমন দুর্ঘটনা! মায়ের কোলও নিরাপদ নয়!’’

Majerhat Majerhat Bridge Kolkata Flyover Collapse মাঝেরহাট Panic
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy