Advertisement
E-Paper

এ শহরে চুম্বকের টানেও ওঠে টাকা

গঙ্গার ধারেই কাশীপুরের জ্যোতিনগর বস্তিতে ঘর আনসার, মারুক, সইদুলের। গঙ্গার নীচ থেকে পয়সা তোলাই ওঁদের জীবিকা।

দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩২
খোঁজ: রুজির টানে ওঁরা নৌকায় সওয়ার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

খোঁজ: রুজির টানে ওঁরা নৌকায় সওয়ার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ভাটা শুরু হবে। দ্রুত নৌকা নিয়ে নামতে হবে গঙ্গায়। আর দেরি না করে আট বছরের ভাগ্নে আর বছর বারোর পড়শি কিশোরকে নিয়েই নাও ভাসিয়েছিলেন আনসার আলি। কাশীপুর ফেরি ঘাট থেকে সোজা পৌঁছে গিয়েছিলেন বাগবাজারে মায়ের ঘাটে। চার-পাঁচ ঘণ্টা সেখানে ঘুরে ফের যখন নৌকা নিয়ে কাশীপুর ফেরি ঘাটে ফিরলেন আনসার, হাতে তখন পাঁচশো টাকার খুচরো কয়েন! সেই পয়সা ভাগ হবে তিন জনের মধ্যে। এক এক জনের ভাগে পড়বে দেড়শোর বেশি। সেটাই এক দিনের রোজগার।

আনসার একা নন। রয়েছেন মারুক বিশ্বাস, সইদুল রহমানেরাও। ভাটা এলেই এঁরা নৌকা ভাসিয়ে দেন গঙ্গায়। দাঁড় বেয়ে কখনও বাগবাজারে মায়ের ঘাট, কখনও দক্ষিণেশ্বর পেরিয়ে বালি ব্রিজের নীচে আবার কখনও বাবুঘাট তো কখনও হাওড়া ব্রিজের তলায়। তাঁদের হাতে থাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা লোহার একটি চৌকো নিরেট জিনিস। পাড়ের কাছাকাছি এলেই সেই লোহার জিনিস ওঁরা ছুঁড়ে ফেলেন গঙ্গায়। এর পরে নৌকার দাঁড় বেয়ে তর তর করে এগিয়ে যাওয়া। বড়জোড় কয়েক মিনিট। দড়ি ধরে টান মারলেই উঠে আসে কখনও দু’টাকা, কখনও পাঁচ আবার কখনও দশ টাকার কয়েন! ভাটা থেকে শুরু করে পরের জোয়ার পর্যন্ত নৌকা ভাসাতে পারলেই দিনে তিনশো-চারশো টাকা রোজগার নিশ্চিত।

গঙ্গার ধারেই কাশীপুরের জ্যোতিনগর বস্তিতে ঘর আনসার, মারুক, সইদুলের। গঙ্গার নীচ থেকে পয়সা তোলাই ওঁদের জীবিকা। মারুক আর সইদুল বছর দশেক ধরে এ ভাবে পয়সা কুড়িয়ে বেড়ান। এতেই স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে ওঁদের সংসার চলে যায়। ছেলেমেয়েকে পড়ানোর খরচও ওঠে এই টাকা থেকেই। তবে এর জন্য বিশেষ এক ধরনের চুম্বক ওঁরা কিনে আনেন বড়বাজার থেকে। প্রায় সকলের বাড়িতেই দু’টি-তিনটি করে সেই চুম্বক রা খা থাকে। কারণ ওটাই ওঁদের সম্পদ। কখনও নিজেরা নৌকা নিয়ে নামেন, তো কখনও আবার তাঁদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া করে অন্যেরা গঙ্গায় ভাসেন পয়সা কুড়োতে। যেমন, বুধবার নবী দিবসের সকালেই গঙ্গায় নেমেছিলেন আনসার। এক ভাটা থেকে পরের জোয়ার পর্যন্ত নৌকা ভাড়া লাগে ৩০ টাকা। ওই দিন গঙ্গা তাঁকে দিয়েছে পাঁচশো টাকা। অর্থাৎ নিট লাভ ৪৭০ টাকা।

টাকা তোলার সেই চুম্বক।

ঘাটের ধার ধরে হাঁটলে নজরে পড়বে, বাচ্চারাও থার্মোকলের টুকরো কিংবা প্লাস্টিকের বোতল ভর্তি বস্তা নিয়ে জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাদের হাতেও থাকে চুম্বক বাঁধা সেই দড়ি। তারাও জানে এই চুম্বক জলে ফেললেই উঠে আসবে পয়সা।

কিন্তু গঙ্গার নীচে এত পয়সা আসে কোথা থেকে? জ্যোতিনগর বস্তির বাসিন্দা হাফিজুল রহমান জানালেন, মূলত যে সব ঘাটে পুজো দিতে আসেন লোকজন সেখান থেকেই মেলে এই পয়সা। আবার কেউ কেউ মা গঙ্গার উদ্দেশে পয়সা ফেলে প্রণাম করেন। সেগুলিই গঙ্গার তলায় জমে। তাই মাঝ গঙ্গায় এ পয়সা মেলে না। পয়সা মিলবে কিছু কিছু ঘাটের ধারে। যেমন বাগবাজার মায়ের ঘাট, বালি ব্রিজ এবং হাওড়া ব্রিজের নীচে, কাশীপুর সর্বমঙ্গলা ঘাট, নিমতলা ঘাট, বাবুঘাটে মিলবে এই খুচরো পয়সা। এই ঘাটগুলিতে পুজো দিতে এসে পয়সা ফেলে যান ভক্তেরা। মারুক জানালেন, শুধু পয়সা নয়। গঙ্গার নীচ থেকে মেলে লোহার অনেক জিনিস। সেগুলির মরচে তুলে ছাট লোহার দোকানে বিক্রি করে দাম পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে রোজ এক এক জনের উপার্জন প্রায় তিনশো হয়েই যায়।

তবে পয়সা বা লোহার জিনিস ভেবে শেল তুলে দুর্ঘটনাতেও পড়তে হয়েছে জ্যোতিনগর বস্তিকে। ২০০৩ সালের ঘটনা। গঙ্গা থেকে লোহা ভেবে শেল তুলে তার উপরে পেরেক আর হাতুড়ি মেরে ফেলেছিল এক কিশোর। মুহূর্তের মধ্যে ফেটে যায় সেটি। ঘটনায় সেই কিশোর ছাড়া আরও কয়েক জন জখম হয়েছিল। হাফিজুলের স্মৃতির ঝুলি থেকে বেরলো অন্য একটি ঘটনা। ২০১৬ সাল। সে বার চুম্বকে আটকে যায় লোহার কোনও জিনিস। তবে তা ভারী হওয়ায় তোলা যায়নি। পরে গঙ্গায় ডুব দিয়ে দেখা যায় জলের নীচে আস্ত একটি কামান! থানায় খবর দিয়ে তা তোলা হয়। পরে তা বন্দর কর্তৃপক্ষ রীতিমতো আদালতে গিয়ে নিজেদের মালিকানায় আনেন।

মাঝে মধ্যে ঘটে যাওয়া এই ব্যতিক্রমকে পাশে রেখেই ৭০-৮০টি পরিবার আজও জীবিকার খাতিরে পয়সা কুড়োতে গঙ্গায় নামে। অকুতোভয় কিশোরও। কারণ, সে-ও জানে, এ শহরে শুধু বাতাসে নয়, জলেও টাকা থাকে। কেবল জানতে হয় উপার্জনের উপায়।

Ganges River
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy