বিদেশি গাড়ির রমরমা। রিপন স্ট্রিটে সোহরাবের বাড়িতে। (বাঁ দিক থেকে) হামার, টয়োটা ফরচুনার, পোর্শে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
রাজা-বাদশাদের হাতিশালে থাকত হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। আর রেড রোডে বায়ুসেনা অফিসারকে গাড়ির ধাক্কায় পিষে ফেলার ঘটনায় ফেরার ফল ব্যবসায়ী মহম্মদ সোহরাবের গাড়িশালে? শুধুই দামি দামি গাড়ি!
বায়ুসেনা অফিসারকে ধাক্কা দেওয়া গাড়িটি প্রায় ৮৫ লক্ষ টাকার অডি কিউ সেভেন। শনিবার রিপন স্ট্রিটে সোহরাবের বাড়ির গ্যারাজে তিনটি গাড়ির দেখা মিলেছে। একটি পোর্শে। দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা। গত বছর কলকাতায় ২০টিরও কম পোর্শে বিক্রি হয়েছে। রয়েছে একটি হামার। এর কোনও ডিলার কলকাতাতেই নেই! দিল্লিতে এর দাম ৪৫ লক্ষ টাকা। তৃতীয়টি টয়োটা ফরচুনার। দাম প্রায় ২৮ লক্ষ টাকা।
সোহরাবের দুই ছেলে, আম্বিয়া ও সাম্বিয়ার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি রেঞ্জ রোভার ইভোক, একটি বিএমডব্লিউ কনভার্টিব্ল্ ও একটি মার্সিডি়জ এসইউভি-র ছবি। এই তিনটি গাড়ির দাম যথাক্রমে ৫০ লক্ষ, ৮০ লক্ষ ও ৬০ লক্ষ টাকা!
অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও ফুটপাথে মুসম্বি বেচতেন সোহরাবের বাবা রুস্তম। তাঁকে সবাই চিনত ‘মুসম্বিওয়ালা’ নামে। সোহরাবের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মধ্য কলকাতার কলাবাগান বস্তির ঘুপচি ঘরে!
আর এখন? পুলিশের একটি সূত্রের খবর, উত্তরাখণ্ডে জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কের কাছে রামনগরে সোহরাব বিলাসবহুল বাংলো তৈরি করেছেন। বাংলো লাগোয়া তাঁর বিশাল ফলের বাগান।
২০০৬-এ জোড়াসাঁকো থেকে বামফ্রন্ট সমর্থিত আরজেডি প্রার্থী হিসেবে জিতে বিধায়ক হন সোহরাব। তখন নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় জানিয়েছিলেন, তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ এক কোটি টাকার কিছু কম। পাঁচ বছর বিধায়ক থাকার পর ২০১১-তে জেডি (ইউ) প্রার্থী হয়ে ফের ভোটে দাঁড়ালেও হেরে যান। সে বার কমিশনে দেওয়া হলফনামায় সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা!
সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, ‘‘সোহরাব বাম-সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন, বামফ্রন্টের নয়। ভোটে জেতার পর তিনি কী করবেন, তা নিয়ে বামফ্রন্টে আলোচনা করতেন না।’’
২০১১-র হলফনামায় নিজেকে ‘তাজা ফলের’ ব্যবসায়ী ও দর্জি বলে পরিচয় দেওয়া সোহরাব জানিয়েছিলেন, তাঁর কোনও গাড়ি নেই! গোয়েন্দাদের দাবি, ‘‘গাড়িগুলো হয়তো স্ত্রী ও ছেলেদের নামে কেনা।’’
বাবার ফলের ব্যবসা হাতে নেওয়া ইস্তক বাংলাদেশে ভাল যোগাযোগ গড়ে ওঠে সোহরাবের। বাংলাদেশের একটি মোবাইল-সিমও তিনি ব্যবহার করেন বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, ১৯৯৩ সালে বউবাজার বিস্ফোরণ-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া সাট্টা ডন রশিদ খানের ৩০ কোটিরও বেশি টাকা তাঁর হাতে আসে। রশিদ ওই টাকা সোহরাবকে দিয়েছিলেন বাংলাদেশে চালান করতে।
পুলিশ জানাচ্ছে, বাংলাদেশে না পাঠিয়ে রশিদের ওই টাকা কলকাতাতেই খাটান সোহরাব। পুরনো বাড়ি কিনে নতুন চেহারা দিয়ে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে বিক্রি করেছেন। পুরনো হোটেল কিনে ঝাঁ চকচকে চেহারা দিয়ে ফায়দা লুটেছেন। বামফ্রন্ট জমানায় সরকারের শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ মুর্শিদাবাদের এক ব্যবসায়ী সোহরাবের নির্মাণ ব্যবসায় টাকা খাটিয়েছেন। বিহারের কয়েক জন নেতাও তাঁদের টাকা সোহরাবের ব্যবসায় লাগিয়েছেন।
এতে খারাপটা কোথায়?
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সোহরাব এখন আর ফল ব্যবসায়ী নন, ফল-মাফিয়া! ফলমান্ডিতে ব্যবসা করতে গেলে সোহরাবকে ‘সন্তুষ্ট’ করতে হয়! আবার পুরনো বাড়ি কেনার পথে কোনও ভাড়াটে বেঁকে বসলে সোহরাবের লোকেরা জোর করে তাঁকে উচ্ছেদ করে— এটাই দস্তুর! বিধায়ক হওয়ার পরে এগুলো বাড়ে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বিস্তীর্ণ তল্লাটে বহু বেআইনি নির্মাণের পিছনে সোহরাব-রাজ!
পুলিশ সোহরাবকে ধরেনি কেন? লালবাজারের এক কর্তার দাবি, ‘‘ক্ষমতা যে দিকে, সোহরাবও সে দিকে। তা ছাড়া, বর্তমান শাসক দল ঘনিষ্ঠ এক ইনস্পেক্টরের কালো টাকা খাটে ওর ভাইয়ের ব্যবসায়!’’
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘মহম্মদ সোহরাব তৃণমূলের সদস্য নন। তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy