Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কাপড়ে মুড়ে উদ্ধার রোগী

রোগীর আত্মীয় অনামিকা সাহা বললেন, ‘‘কিছুতেই হাসপাতালের কোনও ঘরে যেতে চাইছে না। বলছে, অনেক কষ্টে বেঁচে গিয়েছি।’’

পড়িমরি: কাপড়ে মুড়ে ওয়ার্ড থেকে বার করা হচ্ছে রোগীকে। বুধবার কলকাতা মেডিক্যালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

পড়িমরি: কাপড়ে মুড়ে ওয়ার্ড থেকে বার করা হচ্ছে রোগীকে। বুধবার কলকাতা মেডিক্যালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৪৫
Share: Save:

আগুন নিয়ন্ত্রণে বলে তখন সবেমাত্র ঘোষণা করেছেন দমকলের আধিকারিকেরা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমসিএইচ বিল্ডিংয়ের সামনে মাটিতে বসে ক্যানসার আক্রান্ত এক মধ্যবয়সি। হাসপাতাল কর্মীরা যতই অনুনয় করছেন, রোগী হাত জোড় করে বলে চলেছেন, ‘‘কোথাও যেতে বলবেন না দয়া করে। বাঁচলে এই খোলা আকাশের নীচেই বাঁচব। ভিতরে বিপদ!’’

মিনিট কয়েক পরে এলেন হাসপাতালের সিনিয়র আধিকারিক। রোগীর আত্মীয় অনামিকা সাহা বললেন, ‘‘কিছুতেই হাসপাতালের কোনও ঘরে যেতে চাইছে না। বলছে, অনেক কষ্টে বেঁচে গিয়েছি।’’ শেষে কোনও মতে হুইলচেয়ারে ওই রোগীকে নিয়ে যাওয়া হল জরুরি বিভাগে। পোশাকের বোঁচকা হাতে নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘ওগুলো আমার সঙ্গেই দিন। দরকার হলে ওটা মাথায় দিয়ে রাস্তায় শোব।’’

বুধবার সকালে মেডিক্যাল কলেজে ওষুধের স্টোরে অগ্নিকাণ্ডের পরে দিনভর এমনই আশঙ্কিত ছিলেন রোগীরা। তাঁদের নিয়ে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিংয়ে ছুটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ভুলতে পারছেন না হাসপাতাল কর্মীরাও। এমসিএইচ বিল্ডিংয়ের স্বাস্থ্যকর্মী ভবানী চট্টোপাধ্যায়, ঋতা সাহা এবং সুজাতা রায়েরা বলছিলেন, মঙ্গলবার রাত থেকেই ডিউটি করছিলেন তাঁরা। বলেন, ‘‘ভোর সাড়ে ছ’টা থেকে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছিল। আমাদের অনেকে সুপারের ঘরে ছোটেন। আমরা যত জনকে যেভাবে পেরেছি, নামিয়ে এনেছি। রোগীদের প্রাণটা তো আগে বাঁচাতে হবে!’’

আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়তেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায় রোগীদের মধ্যে। কাপড়ে জড়িয়ে, কোলে করে রোগীদের কোনও মতে সরিয়ে নিয়ে যান হাসপাতাল কর্মী ও পরিজনেরা। একটি ট্রলিতে এক জনের বদলে দু’-তিন জনকে ওঠানো হয়। এক বৃদ্ধকে দেখা যায় স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার হাতে আর এক জন। অনেকেরই ঠাঁই হয় মেডিক্যাল কলেজের আশপাশের বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নীচে, বারান্দায়। জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগের মেঝেতে তখন রোগীদের ভিড়। তাঁদের কেউ অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। কেউ রোগযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। সাইকায়াট্রি বিভাগের দোতলায় পরপর বসে ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর দল। তাদের মধ্যেই এক জন মায়ের খোঁজে প্রবল কেঁদে চলেছে।

সাইকায়াট্রি বিল্ডিংয়ের একতলায় প্রাথমিকভাবে রাখা হয়েছিল চাঁপা দাসকে। কোনও মতে বললেন, ‘‘জল খাব। আগুন দেখেছি। ওঁরা বাঁচিয়েছেন।’’ আরেক রোগীকে দেখা গেল মাটিতে কাতরাচ্ছেন। শৌচালয় পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে মেঝেয় শুয়েই মূত্রত্যাগ করতে হল তাঁকে। শুধু বললেন, ‘‘আর পারছিলাম না! অনেকক্ষণ এভাবেই...!’’ বহির্বিভাগের মেঝেয় শুয়ে খানাকুলের প্রতিমা হাজরা বলছিলেন, ‘‘পাঁচ মাস ধরে ওই বিল্ডিংয়ে আছি। আমার হার্টের অসুখ। আগুন লেগেছে শুনে সিঁড়িয়ে দিয়ে লাফিয়ে নামতে হল।’’ বাইরে চত্বরের এককোণে বসে থাকা এক মহিলা আবার ভিতরে ঢুকবেন না। বললেন, ‘‘আমার থ্যালাসেমিয়া। এখানেই বসে থাকি বরং।’’

আপৎকালীন পরিস্থিতির জেরে এদিন একসময় বন্ধ হয়ে যায় বহির্বিভাগের ইন্টারনেট পরিষেবা। হাসপাতালের তরফে হাতে লিখেই টিকিট দেওয়া শুরু হয় বেলা দশটার পরে। তার আগে বহু রোগীকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয় এদিন। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে এদিনই আরজি কর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় এক রোগীকে। এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিলেন এমন বেশকিছু রোগীকে এদিন বাড়ি নিয়ে চলে যান পরিজনেরা। হৃদরোগে আক্রান্ত চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস ভর্তি ছিলেন এমসিএইচ বিল্ডিংয়ে। তাঁকে নিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার মুখে পুত্র শম্ভু বলেন, ‘‘বাড়িটাই এখন নিরাপদ।’’

বিকেলে এমসিএইচ বিল্ডিংয়ের একতলা-দোতলায় ঘুরে দেখা গেল, তখনও সেখানে উত্তাপ। ফাঁকা বেডের সারি। নীচে পাতা তোষক ফাঁকা। বাড়ি থেকে আনা টিফিনবক্সের ঢাকনা খোলা। ভিতরে পড়ে রয়েছে খাবার। পাশেই পড়ে রোগীর অক্সিজেন মাস্ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

MEdical College Fire Patient Rescue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE